শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১২:০১ পূর্বাহ্ন

চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে নারী

কলমের বার্তা নিউজ ডেস্ক :
  • সময় কাল : মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২
  • ৬৮ বার পড়া হয়েছে।

দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজস্ব উপার্জনের পথ তৈরি করেছে যেসব নারী, করোনা মহামারি তাদের সেই পথকে আবারও বন্ধুর করে তুলেছে। কাজের অনিশ্চয়তা, ব্যবসায় ক্ষতি, আয় কমে যাওয়া, পারিবারিক সহিংসতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে বাল্যবিয়ের পাশাপাশি এই সময় বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের শিকারও হয়েছেন নারী।

আবার সামনে থেকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজও করে যাচ্ছেন নারীরা। করোনার সময় ডিজিটাল পরিসরে সৃজনশীলতা নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছেন অনেক নারী। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নারী।

তবে দেশে পরিচালিত একাধিক জরিপে করোনাকালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর পিছিয়ে পড়ার চিত্রই তুলে ধরেছে। এমনকি অর্থনীতিতে টিকে থাকা ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া হিসেবে সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে, তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে আছেন। গত বছরের অক্টোবরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ‘কোভিড-১৯ মহামারিতে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতের অবস্থা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে জানায়, ফেব্রম্নয়ারিতে যে নারীর আয় প্রায় ৯ হাজার টাকা ছিল, তা জুনে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার টাকায়। আগস্টে কিছুটা বেড়ে হয় প্রায় ৪ হাজার টাকা। আগের আয়ে ফেরার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী পিছিয়ে আছেন। এতে আরও বলা হয়, ওই বছরের ফেব্রম্নয়ারির তুলনায় আগস্টে নারীর আয় ৫৬ শতাংশ এবং পুরুষের আয় ৪৫ শতাংশ কম ছিল। এরপর কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো জরিপ করেনি। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী। শ্রমে নিয়োজিত নারীর প্রায় ৯২ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয় বিশ্বের প্রায় সবদেশেই। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ২০২২ হিসেবে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’ নির্ধারণ করা হয়েছে।

৮ মার্চ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীরা আছেন সব জায়গায় : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। দেশের মানুষ প্রথমবারের মতো একজন নারীকে স্পিকার হিসেবে দেখেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা রাষ্ট্রদূত হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রী, সচিবসহ জেলা প্রশাসক বা ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা-জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধি বাড়ছে তরতর করে। রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীর অগ্রগতি অব্যাহত। বিবিএসের জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ২০১২ সালে দেশে নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৮২ শতাংশ, সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ শতাংশ।

নারীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের চিত্রও চমৎকার। বিনামূল্যে বই বিতরণের পাশাপাশি উপবৃত্তির ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবস্থান এখন বেশি। উচ্চ শিক্ষায়ও ছেলেদের কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছেন মেয়েরা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন মজবুত হচ্ছে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন  বলেন, দেশের জন্য সমাজের জন্য কিছু করতে নারীদের মধ্যেও ব্যাপক সম্ভাবনা আছে, যা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে নারী কী করতে পারে, সেটাও দেখা গেছে। শিক্ষায় নারীদের  অংশগ্রহণে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে বের হয়েই নতুন নতুন কাজে যোগদান করছেন। নারীদের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে দেশের উন্নয়নে নারীদের আরও বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। যদি নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে তাদের বাচ্চাদের ‘ডে কেয়ার’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বছরের পর বছর গৃহস্থালির কাজ শুধু নারীরাই করে যাচ্ছেন। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। মেয়েদের যাতায়াত বড় একটি বাধা। নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থারও জোরদার করতে হবে।

জানতে চাইলে বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী  বলেন, নারীদের আস্থা ও সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা দরকার। নারীদের ঘর সংসার সামলাতে হয়। সন্তান পালনেও তার ভূমিকা রাখা অপরিহার্য।  এত কিছুর পর অফিসে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। প্রতিটি অফিসে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকতে হবে। আবার একটু বড় হলে স্কুলের ব্যবস্থাও এমন থাকতে হবে যেন অফিস, পড়াশোনা ও ঘর সংসারের মধ্যে সব কাজ সহজে সমন্বয় করা যায়। সে ক্ষেত্রে স্বামী চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী হলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্যোগ স্বামীর দিক থেকেও আসতে হবে। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই আজকাল এসব ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, এখন তো অনেক পরিবারে শিশুর মা সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান, পড়াশোনা করতে সহায়তা করেন। এই শিশুরা মায়ের সান্নিধ্য বেশি পায়। ফলে ব্যবসা বা চাকরিতে উঁচু পদে উঠতে হলে সংসার ও কর্মক্ষেত্রের দায়দায়িত্ব ও কাজ এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে, যেন তাদের শিশু মা-বাবার সান্নিধ্য লাভে ঘাটতি অনুভব না করে। এই অর্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজের সদস্যদের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই নারীর উচ্চতর পদে ভূমিকা রাখা সহজ হবে। এদিকে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের উচ্চতর স্তরে বাংলাদেশের উত্তরণের পেছনে বড় উপাদান হসেবে ভূমিকা পালন করেছেন নারাীরা।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জানালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা অনুসরণ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেই এগিয়ে চলেছে। গত এক দশকে দেশের রপ্তানি আয় মার্কিন ডলারের হিসাবে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক খাত। অর্থাৎ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার কথাটা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনেও ওঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোসহ (বিবিএস) বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নারীর ক্ষমতায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ডিজিটাল আর্থিক সেবা বা (ডিএফএস)। গৃহস্থালির কাজ সামলানো, কর্মক্ষেত্রের ঝামেলাসহ ঘরে-বাইরে চলার পথে প্রতিদিন হাজারও সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পরও দেশের ৮৫ শতাংশ নারী বলছেন, জীবন নিয়ে তারা সুখী। বাকি মাত্র ১৫ শতাংশ বলছেন, তারা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। গ্রামের চেয়ে শহরের নারীরা সুখী বেশি। সবচেয়ে বেশি সুখী বরিশাল বিভাগের নারীরা। আর নিজের জীবন নিয়ে সবচেয়ে কম সুখী রংপুর বিভাগের নারীরা।

বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলার স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ বৈশ্বিক নানা সংস্থার প্রতিবেদনেও। লিঙ্গ সমতার উদ্দেশে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশে নানা আয়োজনে পালিত হয় এই দিনটি। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ক্লারা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।

১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে এসে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

1
Spread the love

নিউজটি শেয়ার করুন....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ বিভাগের আরোও খবর
এই নিউজ পোর্টাল এর কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি দণ্ডনীয় অপরাধ
Design & Developed by Freelancer Zone
themesba-lates1749691102