বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে বাংলাদেশি কোম্পানির। বেসরকারি খাতের অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূলধন বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮৬ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো যেসব দেশে বিনিয়োগ করতে চাইছে তার মধ্যে যুক্তরাজ্য, স্পেন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনের নাম রয়েছে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ওষুধ, ইস্পাত, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে মূলধন বিনিয়োগ করতে চায় সেগুলো হলো- বিএসআরএম, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড, কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেড, সোনারগাঁ সিড ক্রাশিং মিলস লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড। এর মধ্যে বিএসআরএম হংকংয়ে ৫০ লাখ ডলার, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ফিলিপাইনে ১০ লাখ মার্কিন ডলার, রেনেটা যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে যথাক্রমে ৫০ ও ১০ লাখ ডলার, কলম্বিয়া গার্মেন্টস হংকংয়ে ১৫ লাখ ডলার, সোনারগাঁ সিড ক্রাশিং সিঙ্গাপুরে ২৫ হাজার ডলার এবং বাংলাদেশ ভেঞ্চার স্পেনের একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার মূলধন নিতে চায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশি উদ্যোক্তা কর্তৃক বিদেশে বিনিয়োগসংক্রান্ত আবেদন পর্যালোচনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) রয়েছে। ওই কমিটির পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে আজ বাংলাদেশ ব্যাংকে। সেখানে আলোচিত ছয় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হবে।
সূত্র জানান, দেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের এ প্রস্তাবটি এমন সময় হচ্ছে, যার মাত্র কয়েকদিন আগেই দেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে একটি নীতিমালা জারি করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- বিনিয়োগের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান তার বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের অনধিক ২০ শতাংশ বা সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবে। নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো বিদেশে তাদের শাখা অফিস স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে। নীতিমালা অনুযায়ী যেসব বাংলাদেশি কোম্পানি শর্তসাপেক্ষে এ বিনিয়োগ সুবিধা পাবে: রপ্তানিকারকের সংরক্ষিত কোটা হিসেবে পর্যাপ্ত স্থিতি আছে এমন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী সচ্ছল হতে হবে, আবেদনকারীর ক্রেডিট রেটিং অন্তত দুই হতে হবে, যে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে সেটি বাংলাদেশে আবেদনকারীর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুরূপ বা সহায়ক বা সম্পূরক হতে হবে। এছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগ্যতা হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় আয় অর্জনের সম্ভাবনাময় উৎস এবং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধিসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকতে হবে। দেশি উদ্যোক্তার বিদেশে বিনিয়োগ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটির সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইফতেখার আউয়াল ভূঁইয়া জানান, এতদিন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করলেও এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা দেশে ছিল না। কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত জানাত। এক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় লাগত। এখন নীতিমালা হওয়ায় বিদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব মূল্যায়ন সহজ হয়ে যাবে। ফলে প্রকৃত সক্ষমতা রয়েছে যেসব কোম্পানির, তারা প্রয়োজনমাফিক বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন। আলোচ্য ছয় কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাব সম্প্রতি জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হবে বলে জানান এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সচিব।
বিএসআরএম হংকংয়ে নিতে চায় ৫০ লাখ ডলার : বাংলাদেশ স্টিল রি রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) হংকংয়ে স্থাপিত সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নামে ৫০ লাখ (পাঁচ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূলধন স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবপত্রে জানিয়েছে, তারা ২০১৮ বিএসআরএম (হংকং) নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করে, যার মাধ্যমে চীন ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে কাঁচামাল, পণ্য ও যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। বর্তমানে হংকংয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের পুরো কার্যক্রম ঋণনির্ভর। এ ঋণনির্ভরতা কমানোর জন্যই উল্লেখিত মূলধন দেশের বাইরে নিতে চান তারা। গত বছরের ১৪ জুলাই এ বিনিয়োগ প্রস্তাবটি দেয় বিএসআরএম।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল ১০ লাখ মার্কিন ডলার নিতে চায় ফিলিপাইনে : দেশের ওষুধ শিল্পের স্বনামখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রস্তাবে জানিয়েছে- ফিলিপাইনের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর নিবন্ধন ব্যতীত নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে দেশটিতে ওষুধ পণ্য বাজারজাতের কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে বাংলাদেশি কোম্পানি স্কয়ার ব্র্যান্ডের কোনো ওষুধ পণ্য ফিলিপাইনে রপ্তানি করতে হলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাজারজাত করতে হয়। এ কারণে তারা সেখানে নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি স্থাপন করতে চায়, যার মাধ্যমে ৫০টি রেজিস্ট্রার্ড পণ্য বাজারজাতের সুবিধা পাওয়া যাবে। স্কয়ার তার প্রস্তাবপত্রে আরও জানিয়েছে- ফিলিপাইনে আমদানিনির্ভর ওষুধ শিল্পের বাজার প্রায় ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের, যা আসিয়ান অঞ্চলে তৃতীয় বৃহৎ ওষুধ শিল্পের বাজার। এতে দেশটিতে বাংলাদেশি ওষুধ শিল্পের বাজার সৃষ্টি হবে।
আয়ারল্যান্ডে ২০ লাখ ডলার মূলধন নিতে চায় রেনেটা : দেশের আরেকটি নামকরা ওষুধ কোম্পানি রেনেটা লিমিটেড আয়ারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ মার্কিন ডলার মূলধন বিনিয়োগের আবেদন জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া প্রস্তাবপত্রে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস (আয়ারল্যান্ড) লিমিটেড নামে তারা একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ওষুধপণ্য রপ্তানি করলেও ওই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার মূলধন সাত হাজার ১০০ ইউরো। ফলে সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ না থাকায় তাদের থার্ড পার্টি ধরে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানটির নামে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং এলসি খোলার মাধ্যমে সরাসরি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশি ওষুধ পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পাবে।
যুক্তরাজ্যেও বিনিয়োগ করতে চায় রেনেটা : বাংলাদেশে নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানি রেনেটা লিমিটেড যুক্তরাজ্যে তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রেনেটা (ইউকে) লিমিটেডের জন্যও বিনিয়োগ নিতে চায়। এক্ষেত্রে দেশটি সর্বোচ্চ ৫০ লাখ মার্কিন ডলার মূলধন বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা যুক্তরাজ্যে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটির নামে এলসি খোলা, ঋণগ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন ব্যয় ও লাইসেন্স ক্রয় বাবদ এ অর্থ খরচ করবে বলে জানিয়েছে।
হংকংয়ে ১৫ লাখ ডলার নিতে চায় কলম্বিয়া গার্মেন্টস : দেশের তৈরি পোশাক শিল্প কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেড হংকংয়ে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে বিনিয়োগের লক্ষ্যে দেড় মিলিয়ন বা ১৫ লাখ মার্কিন ডলার মূলধন নিতে চায়। প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাপত্রে জানিয়েছে, ওই সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে তারা বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আরও বেশি দক্ষতার সাথে দর কষাকষি, অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রপ্তানি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেবে।
সূত্র জানায়, কলম্বিয়া গার্মেন্টসের এ বিনিয়োগ প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- প্রস্তাবিত বিনিয়োগের প্রায় ৯৬ শতাংশ অর্থ বিল্ডিং খাতে (অফিস ক্রয়, ভাড়া) ব্যয় করা হবে। অর্থাৎ ১৫ লাখ ডলারের মধ্যে ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ডলার ব্যয় হবে অফিস বাবদ। সামগ্রিক পর্যালোচনায় এ বিনিয়োগ প্রস্তাবটিতে হিসাবের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করতে চায় সোনারগাঁও সিড ক্রাশিং : প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাবপত্রে জানিয়েছে- তারা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ, সাপ্লাইচেইনে ঝুঁকি কমানো, সুলভ মূল্যে পণ্য সংগ্রহ এবং ক্রেতাদের আরও কম মূল্যে পণ্য সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি স্থাপনের জন্য ২৫ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বীজ সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব কোনো ইআরকিউ অ্যাকাউন্ট নেই। তারা একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান তাসনিম কেমিক্যাল কোম্পানির নামে এ বিনিয়োগ নিতে চায়। এছাড়া প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটির মাত্র এক বছরের রপ্তানি অভিজ্ঞতা রয়েছে।
স্পেনে বিনিয়োগ নিতে চায় বাংলাদেশ ভেঞ্চার : প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রস্তাবপত্রে বলেছে- তারা বায়োএগ্রো, স্পেন, নামে একটি এগ্রোগেট কোম্পানির শেয়ার বা মালিকানা কিনতে ১০ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে চান। ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে তারা দেশটিতে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি স্থাপনের সুযোগ পাবেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাব সম্পর্কে বিভাগীয় পর্যালোচনায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল স্পেনের কোম্পানিটির মাত্র ০ দশমিক ৮৫ শতাংশ মালিকানা লাভ করবে, যা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ শেয়ারের (৫০ শতাংশের বেশি) তুলনায় অত্যন্ত কম।