ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল কেমন তা বোঝার অন্যতম উপায় হলো মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, আমদানি-রপ্তানি ও বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বা প্রবৃদ্ধি কেমন তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে ওমিক্রনের মধ্যেও বেড়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, আমদানি-রপ্তানি ও ব্যক্তি খাতে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ওপরে ছিল। তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে আসে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমতে থাকে। ২০২০ সালের মে মাস শেষে প্রবৃদ্ধি নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি নভেম্বরের চেয়ে দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১০ দশমিক ৬৮তে উঠেছে। যা নভেম্বরে ছিল ১০.১১ শতাংশ। এতে বোঝা যাচ্ছে, ২০২০ সালের নভেম্বরের চেয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, অধিক পরিমাণ আমদানি বৃদ্ধি, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়ার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়ছে।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির পর যা একটি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট গুডস ৭০ শতাংশ, রাসায়নিক সার ১০৫ শতাংশ, ইয়ার্ন ১০৩ শতাংশ এবং ড্রাগস ও মেডিসিনের এক হাজার শতাংশের বেশি আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো দিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার মানে নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে।’
তবে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এ খাতে ফের কিছুটা প্রভাব ফেলবে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, জানুয়ারির শুরু থেকে কোভিড আক্রান্তের পরিমাণটা বাড়ছে। এর ফলে আগামী মাসে বেসরকারি ঋণ কিছুটা কমতে পারে তবে ফেব্রম্নয়ারিতে আবার বাড়বে বলে প্রত্যাশা তার।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। তবে এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। অবশ্য এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনো প্রায় ৪ শতাংশ ঋণ কম নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোভিডের কারণে গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুবই কম ছিল। সে সময়ে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে আসে। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ে।
২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রম্নয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণপ্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের কোয়ার্টারলি ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি এসেসমেন্ট রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, করোনা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিয়েছে। তবে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই এক্সটার্নাল ট্রেড বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও আবার বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতি ঠিক হতে থাকলে এই বছরের শেষ নাগাদ বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি তার গতি ফিরে পাবে বলে আমরা আশা করতে পারি।’