অনলাইন ডেক্সঃ
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালবাসা দিবস। বাঙালীর বসন্ত। দুটো এবার একই দিনে উদ্যাপিত হবে। দেশে প্রথমবারের মতো ঘটছে এমন ঘটনা। শুধু এবার নয়, বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাব বদলে যাওয়ায় ভবিষ্যতে এ নিয়মেই দিবস দুটি উদ্যাপিত হবে। ‘একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনিÑ/তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী…।’ ভালবাসা দিবসে শুক্রবার রচিত হবে ফাল্গুন। বসন্তের সঙ্গে আরও বেশি জুড়ে যাবে ভালবাসা।
এতকাল পহেলা ফাল্গুনের দিনটি ছিল বাসন্তী রঙের। হলুদে ছেয়ে থাকত। আর ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবসের রং বরাবরই লাল। কিন্তু এবার কোন রঙে সেজে বের হবে মানুষ? না, ঠিক বলা যাচ্ছে না। একটা রহস্য তৈরি হয়েছে। উদ্যাপনেও ভিন্নতা থাকতে পারে বলে ধারণা। কী হচ্ছে সব মিলিয়ে? দেখার জন্য শুধু আজকের দিনটির অপেক্ষা।
বসন্তের কথাটি আগে বলে নেয়া যাক। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ছয়টি ঋতুর অধিকারী বাংলাদেশ। বসন্তকে এগুলোর মধ্যে সেরা জ্ঞান করা হয়। বলা হয়, ঋতুরাজ। শীতে প্রকৃতি বেশ রুক্ষ থাকে। পাতা হারাতে থাকে বৃক্ষ। জলের অভাবে ভূমিভাগ শুকিয়ে যায়। ধুলো ওড়তে থাকে বাতাসে। এ অবস্থায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করতেই যেন বসন্ত আসে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বসন্ত বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…। বইতে শুরু করেছে বসন্তের বাতাস। নতুন ঋতুর আগমনী টের পাওয়া যাচ্ছে। ফাল্গুনের প্রথম দিন ঋতুরাজকে বরণ করে নেয় বাঙালী। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১ ফাল্গুন উদ্যাপিত হয় বসন্ত উৎসব। এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়। রাজধানী ঢাকাজুড়েই চলে উৎসব অনুষ্ঠান। দেখে ঠিক বোঝা যায়, বসন্ত এসেছে। এটি শতভাগ বাঙালী সংস্কৃতির উৎসব। এ সময় বনে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি বদলে যেতে থাকে মানুষের মন। ভেতরে এক ধরনের শিহরণ জাগে। পুলক অনুভূত হয়। পহেলা ফাল্গুনে বাঙালী নারী বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে ঘর থেকে বের হয়। কাঁচা রঙিন ফুল দিয়ে খোঁপা সাজায়। গলায় বা হাতে প্যাঁচিয়ে নেয় গাঁদার মালা। অনেকে আবার কাঁচা ফুলে তৈরি ক্রাউন মাথায় দিয়ে রাজকুমারীর মতো হেঁটে বেড়ান। পুরুষরাও এদিন একই রঙের পাঞ্জাবি পরেন। অবশ্য শুধু নারী পুরুষ নয়, সব বয়সী মানুষ বসন্তের দিনে কাঁচা হলুদ রংটিকে বেছে নেন। শহর ঢাকায় এদিন আর কোন রং, বলা চলে, দেখাই যায় না। শহর ঢাকা বাসন্তী রঙে ঢাকা পড়ে। পহেলা ফাল্গুনের এটি চিরচেনা ছবি।
অন্যদিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবস পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে এসেছে। পাশ্চাত্যের হলেও, ভালবাসা তো ভালবাসাই, একে আশ্চাত্য পাশ্চাত্য বলে ভাগ করা চলে না। তাই বাঙালীও ভীষণ লুফে নিয়েছে। এখন ঘটা করেই উদ্যাপিত হয় ভ্যালেন্টাইনস ডে। এ দিবসের শুরুটা হয়েছিল প্রাচীন রোমে। কীভাবে শুরু? তার আছে একাধিক গল্প। অপেক্ষাকৃত বেশি শোনা গল্পটি এরকমÑ সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদিন সবাই লাল রঙে সেজে বাসা থেকে বের হন। বিশেষ করে উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণীরা লাল শাড়ি ও একই রঙের পাঞ্জাবি পরিধান করেন। বাংলাদেশের প্রেমিক-প্রেমিকারাও দিনটির জন্য গোপনে অপেক্ষা করে থাকেন। ভালবাসা দিবসে পরস্পরের হাত ধরে অজানায় হারিয়ে যেতে চান। একে অন্যকে গ্রিটিংস কার্ড ফুল চকোলেটসহ নানা উপহার দেন।
কিন্তু এবার একই দিনে দুটি উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর পর্যন্ত ১ ফাল্গুন মানে ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। সে অনুযায়ী, ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হতো। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি সবাই মাততো ভালবাসা দিবসের আনুষ্ঠানিকতায়। এভাবে প্রথম দিন বাসন্তী রং, পরের দিন আমূল বদলে রংটি হয়ে যেত লাল। পরপর দুদিন উৎসবে মাততো ঢাকা। এবার হিসাব নিকাশ বদলে গেছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে পরিবর্তন আনার ফলে ১৪ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনের দিন গোনা শুরু হবে। খ্রিস্টীয় সন গণনায় যেহেতু কোন পরিবর্তন নেই সেহেতু ভালবাসা দিবস থাকছে আগের মতোই। ফলে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালাবাসা দিবস হিসেবে যথারীতি উদ্যাপিত হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে বসন্ত উৎসব। যেদিন বসন্ত উৎসব, সেদিনই ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেন্টাইনস ডে।
ফলে উদ্যাপনের ছবিটা কেমন হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেউ বলছেন, বাঙালী হিসেবে বসন্তকেই সামনে রাখবেন সবাই। বাসন্তী রঙেই সাজবে বাংলাদেশ। আবার কারও কারও মতে, ‘ভালবাসি’ বলার জন্য ভ্যালেন্টাইনস ডে’র চেয়ে বিশেষ দিবস আর হয় না। উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন? এ প্রশ্নটিও এদিনই করা যায় শুধু। এ কারণে অনেকেই ভালবাসার লাল রঙে সেজে ঘর থেকে বের হবেন। অর্থাৎ বিগত দিনের মতো শুধু হলুদ কিংবা লাল রঙের হবে না। উভয় রঙের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যেতে পারে। এরই মাঝে তার কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। ঋতুভিত্তিক উৎসবের পোশাক তৈরি করেন এমন ফ্যাশন হাউসগুলো একই পোশাকে ব্যবহার করেছেন হলুদ ও লাল রং। ডিজাইনারাও পরামর্শ দিয়ে বলছেন, বাসন্তী এবং লাল রঙের কম্বিনেশন হতে পারে। এতে বৈচিত্র্য বাড়বে বৈ কমবে না।
অবশ্য বসন্ত উৎসব এবং ভালবাসা দিবসের পোশাকী রঙে পার্থক্য থাকলেও, মূল জায়গায় মিল আছে। দুটোই প্রেমের বোধকে জাগিয়ে দেয়। মনকে ভালবাসার জন্য তৃষ্ণার্থ করে তুলে। বসন্তের ফুলে ভরা বাগানের দিতে তাকিয়ে হয়তো তাই কবিগুরুকে বলতে হয় : ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল…। ভাললাগা ভালবাসার সৌরভ ছড়ানো নয় শুধু, ভালবাসা দিবসের মতো মিলনের লগ্ন নিয়ে আসে বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহ-মন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোন। ভীরু প্রাণে তাই বেজে ওঠে: মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে…। বলার অপেক্ষা রাখে না, একই বাণী প্রচার করে ভ্যালেন্টাইনস ডে। ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালবাসা দিবস এবং বাঙালীর বসন্ত মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে এবার। এই মিলে মিশে যাওয়ার ফলে একদিনের উৎসব কাটা পড়ল বটে, আনন্দ তাতে কমবে না। কমবে না বলেই আশা করা হচ্ছে।