রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শান্তনু কুমার মিশ্র বলেন, ‘প্রথমেই প্রকল্পের আশপাশের এলাকায় গ্রামবাসীর স্বাস্থ্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নিকটবর্তী একাধিক গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজনের মাধ্যমে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৮০ হাজার ৮৭৯ জন গ্রামবাসীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থিত নিরাময় মেডিক্যাল সেন্টারে দৈনিক গড়ে প্রায় ৫০ জন মানুষ জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছে। বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে শতাধিক ওষুধ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নিরাময় মেডিক্যাল সেন্টারে রক্ত পরীক্ষা (সিবিসি, সুগার, লিপিড প্রফাইল), প্রস্রাব পরীক্ষা, হেপাটাইটিস বি, ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের পরীক্ষা নামমাত্র মূল্যে করা হচ্ছে।
এখানে সেবা নিতে আসা দিগরাজ গ্রামের জোবায়ের হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পেট ব্যথার কারণে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। এই হাসপাতাল চালু হওয়ার আগে আমাদের অনেক দূরে (বাগেরহাট সদর) যেতে হতো চিকিৎসার জন্য। এখন বাড়ির কাছেই ডাক্তার দেখাতে পারি। ওষুধও পাই ফ্রি।’
দাকোপ থানার চুনকড়ি এলাকার বাসিন্দা ঠাকুর দাস মণ্ডল। কাজ করতে গিয়ে হাতের একটি আঙুলের বড় অংশই কেটে যায়। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ বলে জানান। তিনি বলেন, ‘হাতের আঙুল কাটার পর আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলে ডাক্তার খুব যত্ন নিয়ে চিকিৎসা করেন। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ, আগের মতো কাজ করতে পারছি। চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য কোনো টাকা লাগেনি।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাসপাতাল নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করেছে। এখানে ইমার্জেন্সি ও আউটডোর—দুটি সেবায় সার্বক্ষণিক চালু আছে। দৈনিক ৪৫ থেকে ৫০ জন মানুষ আসে চিকিৎসা নিতে। নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন পরীক্ষা করানোর সুযোগ রয়েছে এবং ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে।
বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা
বাগেরহাট জেলার রামপাল ও মোংলা উপজেলার বেশির ভাগই লবণাক্ত এলাকা। গ্রামবাসী নির্ভর করে বৃষ্টির পানির ওপর। এই দুই উপজেলায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ১১টি রিভার্স অসমোসিস (আরও) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে তিন হাজার ৫০০ পরিবার উপকৃত হচ্ছে।
মোংলার দিগরাজ বাজার আল-জামিয়াতুল আরাবিয়া মজিদুল উলুম দিগরাজ কওমি মাদরাসা ও এতিমখানার সামনে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের একটি প্লান্ট বসানো হয়েছে। এখান থেকে আশপাশের এলাকার মানুষজন নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি নিচ্ছে। তাদেরই একজন স্থানীয় রাজমিস্ত্রি মো. জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে খাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। বোতলজাত পানি কিনে এনে খাওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করায় কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই প্রয়োজনমতো পানি নেওয়া যাচ্ছে।’
দিগরাজ মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক মঈনুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই এলাকার পাতালের পানি, পুকুর-খাল ও বিলের পানিও নোনা, খাওয়া যায় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষ থেকে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করার পর থেকে আমরা পানির কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
কর্মসংস্থান
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বিপুলসংখ্যক স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এই প্রকল্পের অদক্ষ কর্মীদের প্রায় ৮০ শতাংশই স্থানীয় বাসিন্দা। এ ছাড়া কম্পিউটার ও টেইলারিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় যুবসমাজ ও নারীদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের মধ্যে আইটি সরঞ্জাম ও সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। তাঁরা এখন উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারে আর্থিক ভূমিকা রাখছেন।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কয়েক বছর আগেও এই উপকূলীয় বাসিন্দারা উন্নত জীবনের সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিল না। বৃহৎ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য যোগাযোগব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
শিক্ষা
রামপাল ও মোংলা উপজেলার ১৫টি স্কুল ও চারটি কলেজে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিভিন্ন শিক্ষামূলক উপকরণ, ব্যাগ, ওয়াটার ফিল্টার, ছাতাসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছে। এরই মধ্যে দুই হাজার ২০০ সেট শিক্ষামূলক উপকরণ এবং সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রাইজবন্ড বিতরণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড স্থানীয় দরিদ্র, বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ১২৫টি হুইলচেয়ার বিতরণ করেছে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে রামপাল, মোংলা ও দাকোপ উপজেলার অসহায়দের মধ্যে কম্বল বিতরণ করা হয়। গত কয়েক বছরে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে ১৮ হাজার মানুষকে।
অর্থনীতিবিদরা যা বলেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলায় ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছিল। এটা বিবেচনা করলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির বাড়তি সুবিধা যুক্ত করেছে। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডকে শক্তিশালী করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাইরেও এই প্লান্টের স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে, যার মধ্যে এক নম্বরে বলা যায় স্থানীয় অনেকের সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগের কথা। আবার বিদ্যুৎ পাওয়ার ফলে এলাকায় অনেক ক্ষুদ্র শিল্পও গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমেও অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘আমরা যত দূর জানি, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কার্যক্রমের অধীনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থানীয় নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানে কম্পিউটার ও টেইলারিং প্রশিক্ষণ প্রদান করে সেলাই মেশিন ও কম্পিউটার সামগ্রী প্রদান করছে। তারা সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করেছে, যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, অসহায়দের ত্রাণসামগ্রী ও হুইলচেয়ার বিতরণ করা হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবিদার।’
এই নিউজ পোর্টাল এর কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি ও দণ্ডনীয় অপরাধ।