লালমনিরহাটের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
আশরাফুল হক, লালমনিরহাট : লালমনিরহাট জেলার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে (এমসিএইচ-এফপি) সরকারি অর্থ আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ২৫ লক্ষ ৯ হাজার ৩ শত ৬৫ টাকা ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) ডা. নিশাত উন নাহার এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে।
পরিবার পরিকল্পনা, লালমনিরহাট-এর উপ-পরিচালক মোঃ শাহজালাল কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এই অনিয়মের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি পরিচালক (প্রশাসন), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একাধিকবার কেন্দ্র পরিদর্শন করেও উপ-পরিচালক বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত কোনো মালামাল বা যন্ত্রপাতির হদিস পাননি। স্টক রেজিস্টার ও বিতরণ রেজিস্টার দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা।
সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ওষুধ সংগ্রহ ও এমএসআর খাতে মোট ১০ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯ শত ৯০ টাকা উত্তোলন করা হলেও, বাস্তবে কেন্দ্রে নামমাত্র ওষুধ পাওয়া গেছে। প্রায় পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং আসবাবপত্র মেরামত খাতে প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা উত্তোলিত হলেও এর কোনো স্টক বা হদিস বাস্তবে নেই বা পাওয়া যায়নি।
অ্যাম্বুলেন্সের পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট খাতে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩ শত ৭৫ টাকা এবং মেরামত খাতে ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ড্রাইভারের বক্তব্য অনুযায়ী, বিগত ২-৩ বছরে অ্যাম্বুলেন্স মেরামত করা হয়নি এবং রোগী রেফার না করে অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ।
কম্পিউটার সামগ্রী, মেরামত ও আনুসঙ্গিক খাতে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নিজস্ব কম্পিউটার না থাকা সত্ত্বেও এটি এবং উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় উভয়ে একই কম্পিউটারের বিপরীতে প্রতি বছর অর্থ উত্তোলন করছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা খরচ দেখানো হলেও, পরিদর্শনের সময় কেন্দ্রের ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ ছিল নোংরা। কোনো কেনাকাটার প্রমাণও দেখাতে পারেননি অফিস সহকারী মনোয়ারা বেগম। কর্মচারীদের অভিযোগ ও সময়ক্ষেপণ পরিদর্শনকালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা অভিযোগ করেন যে, হিসাব শাখার দায়িত্বে থাকা মনোয়ারা বেগম প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ দিচ্ছেন না। উপ-পরিচালক বিল ভাউচার দেখতে চাইলে তিনি “আলমারির চাবি ভুলবশত বাড়িতে রেখে এসেছেন” বলে সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করেন। পরে সামান্য বিল ভাউচার দেখালেও তা সরকারি বিধি মেনে করা হয়নি।
মালামালের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায়, উপ-পরিচালক পরিবার পরিকল্পনা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেছেন। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে।
তবে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এটি কেবল ১ বছরের (২০২৩-২৪ অর্থ বছর) অনিয়মের চিত্র। গত ৪ বছরে একই প্রক্রিয়ায় এই কেন্দ্র থেকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়ে থাকতে পারে। উপ-পরিচালকের প্রতিবেদনে উদ্ঘাটিত এই দুর্নীতিকে “পদ্ধতিগত দুর্নীতি” হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষক যোগসাজশ করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ব্যবহৃত কম্পিউটারটি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের। অথচ একই কম্পিউটারের বিপরীতে দুই প্রতিষ্ঠান গত ৪ বছর ধরে কম্পিউটার সামগ্রী ক্রয় ও মেরামতের জন্য বিল উত্তোলন করে আসছে। এভাবে, একই খাত থেকে প্রতি বছর ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে এই সিন্ডিকেট গত ৪ বছরে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
উপ-পরিচালক মোঃ শাহজালাল কর্তৃক প্রেরিত এই প্রতিবেদনটি এখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ঢাকা-এর হাতে। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে শুধু ২০২৩-২৪ সালের ২৫ লাখ নয়, বরং বিগত ৪ বছরের সকল আর্থিক লেনদেন এবং মালামাল সংগ্রহের রেকর্ড বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিতে পারে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ এবং জনগণের সেবা ব্যাহত করার জন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় এবং ফৌজদারি ব্যবস্থা আশা করছে স্থানীয় জনসাধারণ।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত অফিস সহকারি মনোয়ারা বেগম সাংবাদিকদের জানান, আমাকে বিল তৈরি করতে বলেছেন করেছি। ওই বিল সঠিক কি না তাতো আমার দেখার বিষয় নয়। আমি কোন অনিয়ম করিনি।
মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) ডা. নিশাত উন নাহার সাংবাদিকদের বলেন, আমি দীর্ঘ সময় লালমনিরহাটে চাকুরি করে সেবা দিয়েছি। লালমনিরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সরঞ্জামাদি কেনায় অডিট আপত্তির বিষয়টি আমি দেখবো। অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট দেখে কোটি কোটি টাকার অমিল সেখানে ৪-৫ লাখ টাকার অমিলে কি হবে!
এ বিষয়ে লালমনিরহাট পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালক মো. শাহজালাল বলেন, শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৫ লাখ নয়, বরং বিগত চার বছরের সকল আর্থিক লেনদেন ও মালামাল ক্রয়ের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দের পুরো টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রতিবেদনটি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ঢাকা-পাঠানো হয়েছে।








