দুই দফা আদালতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য কালীগঞ্জে ওয়াকফ এষ্টেটের ৩৩.৩৮ একর সম্পত্তি বেদখল
![](https://kolomerbatra.com/wp-content/uploads/2023/10/received_840624707766659-700x390.jpeg)
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় ওয়াকফ এষ্টেটের ৩৩.৩৮ একর সম্পত্তি বেদখলের অভিযোগ উঠেছে। অথচ স্থানীয় একটি মসজিদের নাম ভাঙ্গিয়ে স্বঘোষিত সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক আঃ কুদ্দুস সহ ২৪ চক্রের সদস্য পুরো সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন। একদিনের ব্যবধানে দুই দফা ওয়াকফ এষ্টেটের সম্পত্তি বেদখলকারীদের বিরুদ্ধে আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামলের মালিকানায় বুঝে দেন। দুই দফায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবারো ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি বেদখল করেছেন। এ ঘটনায় মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামল কালীগঞ্জ থানায় জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও আঃ কুদ্দুস সহ ২৪ চক্রের সদস্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে দাবী করেছেন ভোক্তভোগী মোতাওয়ালী।
জানা গেছে, ১৯১৭ সালে বর্তমান জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের নাককাটির ডাঙ্গা ভোটমারী গ্রামের বাসিন্দা বিবি হাজরণ নেছা ও তার স্বামী চিকা মামুদ পবিত্র হজ¦ পালনের পূর্বে নিজ স্বত্ব দখলী সম্পত্তি ১৬৫ একর ৪৫ শতাংশ জমি ওয়াকিফের ওয়ারিশগনের মৌলিক চাহিদা পূরন সহ ওয়াকিফের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার মৌলবি ও শিক্ষকের বেতন-ভাতা প্রদান সহ ধর্মীয় কাজে ওয়াক্ফ করেন। যার তৎকালীন রেজি:কৃত দলিল নং-৩৬০৩। উক্ত দলিলের শর্তানুযায়ী প্রথমে ওয়াকিফার জীবনকাল পর্যন্ত মোতাওয়ালীর দায়িত্ব পালন করেন। ওয়াকিফার মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী চিকা মামুদ মোতাওয়ালীর দায়িত্ব পালন করেন। চিকা মামুদের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র আজগার আলী মোতাওয়ালীর দায়িত্ব পালন করেন। আজগার আলীর মৃত্যু পর তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ইউনুছ আলী মোতাওয়ালীর দায়িত্ব পালন করেন। ইউনুছ আলীর মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ওয়াক্ফ দলিলের শর্তানুযায়ী সাবেক মোতাওয়ালী চিকা মামুদের ওয়ারিশ হিসাবে শফিউল আলম শ্যামল ২৯-০৯-২০১৫ সালে উক্ত ওয়াক্ফ এস্টেটের অফিসিয়ালি মোতাওয়ালীর দায়িত্ব পান। তিনি মোতাওয়ালীর দায়িত্ব প্রাপ্তির পর হতে অদ্যবদি হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি দখলে পাননি।
২০২২ সাল ২৭ জুনে বর্তমান অফিসিয়াল মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামল ওয়াক্ফ অধ্যাদেশে ৬৪(১) ধারায় জমি উদ্ধারের ওয়াক্ফ প্রশাসক বাংলাদেশ, ওয়াক্ফ ভবন, ঢাকা বরাবর আবেদন করেন। ৬২ রের্কডমুলে ওয়াকফ এষ্টেটের ৩৩.৩৮ একর সম্পত্তি উদ্ধার সহ হুমকিদাতা বাদশা আলী, আঃ কুদ্দুস ও রাজ্জাক গং এর নাম উল্লেখ করে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০ নভেম্বর/২২ইং তারিখে ওয়াকফ হিসাব নিরীক্ষক, বৃহত্তম রংপুর থেকে আমিনুল ইসলাম তদন্তে আসেন। তদন্ত শেষে ৩০/০১/২৩ইং তারিখে ওয়াকফ এষ্টেটের সমুদয় জমি মোতাওয়াল্লী শফিউল আলম শ্যামলকে বুঝি দেয়ার সুপারিশ প্রতিবেদন দাখিল করেন। ই, সি, নং-৫২৬৬, হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেট, কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট। ওয়াকফ প্রশাসক অফিস স্মারক নং-১৬,০২,০০০০,০৫৯.৩১.০০০.৩৫/১৩১, তাং-০৪-০৯-২০২২ইং। এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ০৪-১১-২০২২ইং তারিখে ভোটমারী ইউনিয়নের (১নং ওয়ার্ড) ভোটমারী গ্রামের হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি বর্তমান নাককাটির ডাঙ্গা জামে মসজিদ কমিটির নাম ভাঙ্গিয়ে স্বঘোষিত সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক আঃ কুদ্দুস সহ সদস্য মৃত: আ: ছাত্তারের ছেলে আনোয়ার হোসেন গং, মৃত: আজিতউল্যার ছেলে আ: জলিল গং, মৃত: আ: জব্বারের ছেলে মফিজুল ইসলাম গং, মৃত: সহির উদ্দিনের ছেলে আবু তালেব, মৃত: আব্দুল জব্বারের ছেলে আমিন আলী গং, মৃত: ছলে শেখের ছেলে খলিল মিয়া গং, মৃত: আব্দুল জব্বারের ছেলে জাহেদুল ইসলাম, খলিল মিয়ায় ছেলে রবিউল ইসলাম, মৃত: ছলে শেখের ছেলে আব্দুল জলিল, খলিল মিয়ায় ছেলে রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেনের ছেলে আইয়ুব আলী, মৃত: মতিয়ার রহমানের ছেলে হাবলু মিয়া, মৃত: ছলে শেখের ছেলে খলিল মিয়া গং, মৃত: কছর উদ্দিনের ছেলে মজিবর রহমান গং ১২.২২ একর জমি ৮ লক্ষ ৬২ হাজার টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে লিজ গ্রহন সহ ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি ভোগদখল করছেন। এভাবেই ২০১৫ সাল থেকে অবৈধ ভাবে জোড়পূর্বক জমি দখলে নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নাককাটির ডাঙ্গা জামে মসজিদ কমিটির নাম ভাঙ্গিয়ে স্বঘোষিত সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক আঃ কুদ্দুস গংরা ওয়াক্ফ প্রশাসক কর্তৃক অনুমোদন প্রাপ্ত কমিটি নয়। অপরদিকে ১৯/৩/২৩ইং তারিখে ওয়াকফ প্রশাসকের স্মারক নং ১৬.০২.০০০০.০৫৮.৩১.০০০.৩৮/ মুলে মোতোওয়াল্লীকে জমি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক, লালমনিরহাটকে অবগত করেন। এবং এস্টেটের সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যক্তিগত নামে বিআরএস রের্কডকৃত ১৯.০৫ একর জমি রের্কড সংশোধনের মামলা করার জন্য মোতোওয়াল্লীকে নির্দেশ প্রদান করেন। উক্ত মোতোওয়াল্লী পত্র পাওয়ার আগে নাককাটির ডাঙ্গা জামে মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আলী হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের পক্ষে ভুয়া।
সেক্রেটারী হিসেবে, ভুয়া সীলমোহর তৈরী করে বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট, অন্য-৪০০/২০২১ইং আত্মসাতের উদ্দ্যোশে মামলা দায়ের করেছেন। তবে উক্ত মামলায় কুদ্দুস আলীকে বাদী হিসেবে বাদ দিয়ে মোতোওয়াল্লী শ্রেণিভুক্তর হওয়ার আবেদন করেন। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
ওয়াকফ প্রশাসকের তদন্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়, বর্তমান ওয়াক্ফ প্রশাসক কর্তৃক নিয়োগকৃত হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের অফিসিয়াল মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামল কর্তৃক হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রয়, নিজের নামে রেকর্ড সৃজন এমনকি হাজরন নেছা হাজীয়ানী ওয়াক্ফ এস্টেটের ক্ষতিকর কোন কাজের সাথে সম্পৃক্ত নেই। এমনকি সরেজমিনে একদল সাংবাদিক স্থানীয়দের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হন।
এদিকে ১৯/৩/২৩ইং তারিখে ওয়াকফ প্রশাসকের স্মারক নং ১৬.০২.০০০০.০৫৮.৩১.০০০.৩৮/ মুলে মোতোওয়াল্লীকে জমি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক, লালমনিরহাটকে অবগত করেন। এর আলোকে জেলা প্রশাসক মিস কেস নং-১২/২০২২-২৩ অনায়ন করেন। লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) টি.এম.এ মমিন দীঘ শুনানী করেন। অভিযুক্ত অবৈধ দখলকারী কুদ্দুস আলী গংরা কোন প্রকার বৈধ কাগজপত্র দাখিল করিতে না পারায় ওয়াকিফার ওয়ারিশ মোতোয়াল্লী শফিউল আলম শ্যামলের পক্ষে রায় প্রদান করেন। সেই সাথে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে মোতোয়াল্লীকে উক্ত জমি বুঝিয়ে দিতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করেন। যার স্মারক নং-জেলা মিস কেস নং-১২/২০২২-২৩/৭৩২(৫), তাং ১০/০৮/২৩ইং। এর প্রেক্ষিতে ২৯/০৮/২৩ ইং তারিখে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জহির ইমাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে ওয়াকফ এষ্টেটের ১৪.৩৩ একর সম্পত্তি আদালতের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামলকে বুঝিয়ে দেন। ওই সময় স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সহ স্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
নাককাটির ডাঙ্গা জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক আঃ কুদ্দুস জানান, অবৈধ ভাবে মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামল ওয়াকফ এষ্টেটের জমি দাবী করছেন। স্থানীয় মসজিদ কমিটির সিদ্ধান্তে মসজিদের উন্নয়নে জমি লিজ প্রদান করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় মসজিদের উন্নয়ন কাজ কিছুটা বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে স্থানীয় ভাবে আপোষ মিমাংসার চেষ্ঠায় সমাধান আসেনি।
মোতাওয়ালী শফিউল আলম শ্যামল বলেন, ২৯/০৮/২৩ ইং তারিখে রাতে অন্ধকারে অবৈধ দখলদাররা লাল পতাকা ও বাঁশের খুঁটি উপড়ে ফেলেন। পরেদিন বিষয়টি নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট-কে অবগত করা হলে তিনি থানা অভিযোগ দিতে বলেন। আবারো ৩১/০৮/২৩ ইং তারিখে পুলিশ প্রশাসন নিয়োগের মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় করেন। পুনঃরায় ০৩/৯/২৩ইং তারিখে জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও আঃ কুদ্দুস গংরা ৬০/৭০ জন ভায়াটিয়া বাহিনী অস্ত্র নিয়ে লাল পতাকা ও বাঁশের খুঁটি উপড়ে ফেলেন। এ ঘটনায় কালীগঞ্জ থানায় জাহাঙ্গীর আলম বাদশা ও আঃ কুদ্দুস সহ ২৪ সদস্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ কোন মামলা নেয়নি। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ প্রশাসন। আইন শৃঙ্খলার বিষয়ে কোন সমস্যা হলে মানুষ থানা গেলে পুলিশ মামলা গ্রহনে অনিহা প্রকাশ করেন। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায়।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমতিয়াজ করিব বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহযোগিতা চেয়েছেন, তাই আমরা সহযোগিতা করেছি। এ ছাড়া আমার করার কিছু নাই এবং তাছাড়া অভিযোগ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জহির ইমাম বলেন, আমি আদালতের নির্দেশে লাল নিশাস গেড়ে জমি মোতোওয়াল্লীকে দখল বুঝিয়ে দিয়েছি। তারপর কেউ আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে তার জন্য আইন আছে। এ বিষয়ে আবারো কোন নির্দেশ আসলে তা বাস্তবায়ন করা হবে।