দেশীয় প্রযুক্তিতে চালু হবে ডেমু ট্রেন

দেশীয় প্রযুক্তিতে চলবে রেলওয়ে ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেন। ২০ সেট ট্রেন পুরোপুরি সচল রাখতে রেলওয়ের রোলিং স্টক (মেকানিক্যাল) বিভাগ থেকে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যারা ডেমু ট্রেনগুলো পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। আগামী ১-২ মাসের মধ্যে এই প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
বৃহস্পতিবার রেল ভবনে ডেমু ট্রেন মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার রেলমন্ত্রী বলেন, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে গত ৯ অক্টোবর ১ সেট ডেমু ট্রেন সচল করা হয়েছে। এটি এখন ভাল সার্ভিস দিচ্ছে।
আমরা এই ট্রেনটি পর্যবেক্ষণ করছি। আরও দুই-এক মাস দেখা হবে। এটি সহ মোট ৬টি ডেমু ট্রেন সচল আছে। ভবিষ্যতে ডেমুগুলো কিভাবে সচল রাখা যায় সেজন্য বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। তারা ডেমুগুলো পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট দেবে। সেভাবে অন্যান্য ডেমু সচল করার জন্য কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, ডেমু মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ডেমু সেটসমূহ সিডিউল ওভারডিউ এবং দীর্ঘদিন মেরামতাধীন থাকার ফলে এর মেকানিক্যাল ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ব্রেক সিস্টেম, কুলিং সিস্টেম, বগি, চাকা, বডি, বাফার, ইঞ্জিন, জেনারেটর, ট্রাকশন মোটর ইত্যাদির মেরামত করতে হবে।
স্বল্প মেয়াদি মেরামতের জন্য মডিউল বেজড অপারেটিং সিস্টেম দেশীয় বাজারে সহজলভ্য যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে আরও ২-৩টি সেট ডেমু ট্রেন সচল করা যাবে বলে বৈঠকে জানানো হয়। মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনায় ডেমুর অবস্থা পর্যালোচনায় ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে আরও ৫টি ডেমু মেরামত করা যাবে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় আগামী বছর ডিসেম্বরের মধ্যে ১৪ সেট ডেমু সচল করা যাবে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর দেশীয় প্রযুক্তির মাধমে সচল করা হয়েছে এক সেট ডেমু ট্রেন। প্রায় ৩ কোটি টাকার স্থলে খরচ হয়েছে মাত্র ৫০ লাখ টাকা। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও ১৪টি ডেমু ট্রেন সচল করা যাবে। সচল হওয়া ডেমু ট্রেনটি গত ১১ দিন যাবত ঘণ্টায় ৬০-৬৫ কিলোমিটার গতিতে পার্বতীপুর-রংপুর রুটে চলাচল করছে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
গত রবিবার দেশীয় প্রযুক্তিতে মেরামত করা পার্বতীপুর-রংপুর রুটে দুটি ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এ সময় রেলমন্ত্রী বলেন, দেশে ২০টি ডেমু ট্রেন রয়েছেÑ তার মধ্যে পার্বতীপুরের লোকোমোটিভে (কারখানায়) মেরামত করা দুটিসহ ৬টি চলাচল করছে। বাকি ১৪টি মেরামতের ট্রায়াল অব্যাহত রয়েছে। ডেমু হচ্ছে একটি স্বল্প দূরত্বের ট্রেন।
২০১৩ সালে ৬৩০ কোটি টাকায় চায়না থেকে এই ট্রেনগুলো আমদানি করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ট্রেনগুলো তারা হস্তান্তর করলেও প্রযুক্তি ও পাসওয়ার্ডগুলো রেখে দেয় তাদের মুখাপেক্ষী করতে। আমাদের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীগণ অনেক গবেষণার মাধ্যমে ট্রায়াল ট্রিটমেন্ট সম্পন্ন করে অচল ডেমুকে সচল করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, চীন থেকে আমদানি করা ডেমু ট্রেনগুলো দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়েছিল। দেশের প্রকৌশলীদের চেষ্টায় সচল হচ্ছে সেগুলো। নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিজেল ওয়ার্কশপে সচল করা হয়েছে ২টি ডেমু ট্রেন। একই প্রযুক্তিতে মোট ১৪টি ডেমু ট্রেন সচল করা যাবে। মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ৬৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয় ২০১৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল ওই সব ট্রেনের মাধ্যমে কাছাকাছি দূরত্বে বেশি পরিমাণে যাত্রী পরিবহন করা। চীনের তানসন ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ডেমু ট্রেনগুলোর নির্মাতা। কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ওই ট্রেনগুলো বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত। এ প্রযুক্তি ডেমু ট্রেন সরবরাহকারী চীনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে কখনো দেয়নি।
এর মডিউল বিকল হলে নতুন মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। এর জন্য ধর্ণা দিতে হতো চীনের প্রকৌশলীদের কাছে, যা ছিল ব্যয়বহুল। একটি ডেমুতে ৪০টি মডিউল আছে। এর একেকটির দাম প্রায় সাত লাখ টাকা। চীনা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি হস্তান্তর না করায় একটির পর একটি ডেমু ট্রেন বিকল হতে থাকে। চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ হবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জিএম অসীম কুমার তালুকদার বলেন, দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে পার্বতীপুরে ১টি ডেমু সচল করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৪টি ডেমু সচল করা যাবে। অন্যগুলো অন্য সমস্যা থাকায় এই প্রযুক্তিতে তা সচল করা যাবে না।
পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার প্রধান নির্বাহী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশি প্রযুক্তিতে ডেমু ট্রেন মেরামত আমাদের বিশাল এক অর্জন। একে বড় সাফল্য বলা যেতে পারে। এ প্রযুক্তিতে ট্রেন মেরামত করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে। তবে এ ধরনের ডেমু মেরামতের জন্য আমাদের ডেডিকেটেড রেলওয়ে কারখানা প্রয়োজন।
জানা গেছে, ডেমু ট্রেনগুলো সচল করার বিষয়ে প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আসাদুজ্জামান ডেমু ট্রেন নিয়ে কাজ শুরুর আড়াই মাসের মধ্যে কী ধরনের প্রযুক্তিতে এগুলো চালাতে হবে, তা বের করেন। ব্যয়বহুল মডিউলের বদলে বসানো হয় মাত্র দুটি কন্ট্রোলার। আর তা দিয়েই প্রথম একটি ডেমু ট্রেন সচল করা হয়।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা পাঁচ সেট ডেমু ট্রেন সচল করতে সক্ষম হয়েছি। দুই মুখে দুটি ইঞ্জিন, মাঝখানে একটি কোচ। এসব আধুনিক ট্রেনে পর্যায়ক্রমে লোড বাড়িয়ে পরীক্ষামূলক চলাচল সম্পন্ন করা হয়েছে। পরীক্ষামূলক আটটি চলাচলের প্রতিটিতে আমরা সাফল্য পেয়েছি। একটি ডেমু ট্রেন মেরামতে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা, চীনের কাছ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে মেরামত করতে খরচ হতো প্রায় ৩ কোটি টাকা।
নতুন চালু হওয়া ডেমু ট্রেনটি প্রতিদিন পার্বতীপুর-রংপুর রুটে চলাচলের সময় বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে যাবে এবং বিকেল ৬টা ১০ মিনিটে রংপুরে পৌঁছবে। একই রুটে বিকেল ৬টা ২০ মিনিটে রংপুর ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে পার্বতীপুরে ফিরে যাবে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।