মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫, ০৪:১৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনামঃ
লালমনিরহাটে মাথা বিহীন মরদেহ উদ্ধার স্বামী ৩ দিনের রিমান্ডে! শ্রীপুরে চার বছরের শিশুর গায়ে সৎ বাবার গরম ছুরির ছ্যাঁকা যশোরের ঝিকরগাছায় জমি দখলকারীদের হামলায় মা-ছেলে জখম বেনাপোলে পাসপোর্টযাত্রীর জাল ভ্রমণকর সরবরাহের অভিযোগে আবারও শামিম আটক দেশব্যাপী নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে বেনাপোল কলেজ ছাত্রদলের মানববন্ধন লালমনিরহাটে সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা-মামলার ঘটনায় মানববন্ধন প্রতিবাদ সমাবেশ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ, যুবককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দিলো জনতা ওসির অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন, হামলায় পুলিশসহ আহত ৫ জন রংপুরের তারাগঞ্জে সাংবাদিক নাজিমের ওপর সন্ত্রাসী হামলা! লালমনিরহাটের আলোচিত হাসিনার কাটা মাথা উদ্ধার গ্রেপ্তার-১

নদীর পাশে ট্যানারি নয়

রিপোর্টারের নাম : / ১৪০ বার পড়া হয়েছে।
সময় কাল : মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০২২

ট্যানারির বর্জ্যে সাভারের ধলেশ্বরী নদী এখন মৃত্যুর মুখে। এর আগে হাজারীবাগে ট্যানারির বর্জ্যে প্রাণ হারিয়েছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাণ ফেরাতে ইতোমধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে সরকার। কিন্তু তাতেও ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হচ্ছে না। প্রাণ ফিরছে না নদীতে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়া হয় সাভারের হেমায়েতপুরে হরিণধরা এলাকায়। আর তাতে এবার দূষিত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। এই নদীর প্রাণ বাঁচাতে ট্যানারি বন্ধের সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের এই সুপারিশের সাথে পরিবেশবিদরাও একমত পোষণ করেছেন। তারা বলেছেন, অর্থ ব্যয় করে কয়েকটা চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা যাবে। কিন্তু যত অর্থই খরচ করা হোক না কেন, নদী মরে গেলে একটি নদী সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সাভারে চামড়া শিল্পনগরী তৈরি প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। অথচ ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও ট্যানারি দূষণে মৃত বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাণ ফেরানো যায়নি। পরিবেশবিদদের অভিমত নদী বাঁচাতে ট্যানারিকে নদীর পাশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক। তা না হলে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরীকেও বাঁচানো যাবে না।

সাভারের ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলায় মারাত্মক দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে নদী ও নদীপারের বাসিন্দারা। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে পরিশোধন না করে ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি ড্রেনেজের পাইপ লাইন দিয়ে ফেলা হচ্ছে নদীতে। চামড়া শিল্প কর্তৃপক্ষ ও মালিকদের কারসাজিতে কল-কারখানার বর্জ্য পড়ছে ধলেশ্বরীতে। এতে করে ধলেশ্বরীও বুড়িগঙ্গার মতো মরতে বসেছে। সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু এখানে বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই কঠিন বর্জ্য ধলেশ্বরীর পাড়ে উন্মুক্ত ডাম্পিং এলাকায় ফেলা হচ্ছে। ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো থেকে দিনে প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হতো। এছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধের পাশে, খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলা হতো। এতে ব্যাপক দূষণের কবলে পড়ে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু বুড়িগঙ্গা তাতেও দূষণমুক্ত হয় নাই। বরং এখন ট্যানারির দূষণে মরছে ধলেশ্বরী।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ট্যানারি দূষণে বুড়িগঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো যাচ্ছে না। এই ট্যানারির দূষণে এখন মৃত্যুর মুখে ধলেশ্বরী নদী। ধলেশ্বরীর পানি প্রবাহ বুড়িগঙ্গাতেও আসবে। একটি নদী তৈরি করা সম্ভব নয়; কিন্তু অর্থ খরচ করে অনেক ট্যানারি তৈরি করা যাবে। কাজেই এই দূষণের বিরুদ্ধে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে। আসলে নদী প্রকৃতির প্রাণ। নদী না বাঁচলে পরিবেশ-প্রকৃতিও বাঁচবে না। যারা নদীকে হত্যা করছে তারা দেশদ্রোহী কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

ট্যানারির বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদী যাতে বুড়িগঙ্গার মতো না হয় এজন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের পর দূষণের দায়ে চামড়া শিল্প নগরীর ১৯টি ট্যানারিকে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগারে বর্জ্য পরিশোধনের শর্তসাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য ছাড়পত্র প্রদানেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে সরেজমিনে বিভিন্ন ট্যানারি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব’কটি ট্যানারিতে উৎপাদন চলছে। কারখানার ভেতরে ও বাইরে ড্রেনগুলোতে জমে আছে বিষাক্ত দুর্গন্ধযুক্ত পানি আর ট্যানারির কঠিন বর্জ্য। কোথাও ট্যানারির বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবার কঠিন বর্জ্য ড্রেন ভরে উপচে সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন ট্যানারি থেকে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে গাড়িতে করে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে বিসিকের উন্মুক্ত ডাম্পিং স্থানে। এটি দেখার কেউ নেই। উৎকট দুর্গন্ধে টিকা দায়। আবার সরাসরি পাইপ দিয়ে বর্জ্য যাচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। এই বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ধলেশ্বরী নদী।

ট্যানারি শ্রমিক মো. জাফর বলেন, ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলায় এই নদীতে এখন আর কেউ নামতে চায় না। নদীর পানি নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, বিভিন্ন রোগবালাই হচ্ছে। নদীতে এখন মাছ নেই। জলজ প্রাণীও মরে যাচ্ছে। এ ছাড়া ট্যানারির বর্জ্যরে দুর্গন্ধে পুরো এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এমন দূষিত পরিবেশে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।

সদর ট্যানারির শ্রমিক আবুল হোসেন বলেন, ট্যানারির দুর্গন্ধ এখন আমাদের সহ্য হয়ে গেছে। কারখানার ভেতরে পরিবেশে তেমন দূষণ হয় না। যা হচ্ছে কারখানার বাইরে। এই বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব বিসিকের তারা এসব বর্জ্য নিয়ে ফেলছে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে। আর তাতে নদী দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ধলেশ্বরী নদী দূষণে ট্যানারির বর্জ্যরে দায় অনেক বেশি। তাই আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, যে ১৯টি প্রতিষ্ঠান কখনওই পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি সেগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবেদন করা ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে শর্তপূরণ সাপেক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যারা আইনকে তোয়াক্কা করছে না, পরিবেশের দূষণ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি পরিবেশ রক্ষায় সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

শিল্প-মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকায় ও দূষণের দায়ে চামড়া শিল্পনগরীর যে ১৯টি ট্যানারিকে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাদের অনেক আগেই নোটিশ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা কোনো কর্নপাত করেন নি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীনের প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়ার পর ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কঠিন বর্জ্য ও সিইটিপি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি করব।

বন্ধের তালিকায় থাকা মেসার্স নিশাত ট্যানারির ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেক আগেই পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলাম। পরিবেশ অধিদফতর ও বিসিক একাধিকবার কারখানা পরিদর্শনও করেছে। গত কয়েকদিন আগে আমরা পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়েছি। তবুও বন্ধের সিদ্ধান্তের তালিকায় নিশাত ট্যানারির নাম দেখে কিছুটা অবাক হয়েছি। আমরা পরিবেশের ছাড়পত্রসহ সমস্ত পেপার্স শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছে দিচ্ছি।

ইব্রাহীম ট্যানারির ব্যবস্থাপক ইউসুফ মোল্লা বলেন, বিসিকের দেয়া নিদের্শনা অনুযায়ী আমাদের ট্যানারির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমাদের কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্রসহ সমস্ত কাগজপত্র আপডেট আছে। এমনকি চলতি বছরের আপডেট অনলাইন কপিও আছে। এরপরও বন্ধের তালিকায় আমাদের কারখানার নাম দেখে আমরা হতবাক হয়েছি।

মেসার্স গোল্ডেন লেদার ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে ট্যানারি করা হয়েছে, হুট করে সিদ্ধান্ত নিলেই কি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। আমাদের যে কয়টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরমধ্যে কয়েকজন ইতোমধ্যে কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। অন্যরা পর্যায়ক্রমে জমা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে আমরা কারখানা স্থানান্তর করি। আমাদের কারখানায় পরিবেশ অধিদফরের কোনো লোক কখনও পরিদর্শনেও আসেনি। আমাদের কোনো নোটিশও করেনি। হঠাৎ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি, পরিবেশ ছাড়পত্রের কোনো আবেদন করা হয়নি এবং পরিবেশ দূষণের অভিযোগে শিল্প মন্ত্রণালয় যে ১৯টি ট্যানারি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরমধ্যে মেসার্স গোল্ডেন লেদার ইন্ডাস্ট্রিও রয়েছে। আমরা গত একমাস আগে অনলাইনে পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি। আবেদনটি রিসিভ করেছে কিনা এখনও জানতে পারিনি। তবে এতো বছর পর পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন কেন করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য ১৫ থেকে ১৬টা কাগজের প্রয়োজন হয়। সব একসাথে জোগাড় করতে সময়তো লাগবেই। তাছাড়া কারখানার মালিক হঠাৎ স্ট্রোক করে অসুস্থ হওয়ায় কাগজপত্র গোছাতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ট্যানারির বর্জ্যরে সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করছে। এ দূষণ অন্যান্য নদীতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ১০০টি ট্যানারির জন্য দেশের বহু মানুষ জিম্মি হতে পারে না। তাই ট্যানারি প্রয়োজনে বন্ধ রেখে সিইটিপি কার্যকর ও কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা নির্মাণ করে চামড়া শিল্পনগরকে পরিবেশসম্মত করা জরুরি। প্রয়োজনে চামড়া শিল্পনগরী নদীর কাছাকাছি থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর