৫৩ লাখ টন পণ্য আমদানির নিশ্চয়তা চায় বাংলাদেশ

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় ৬ পণ্যের ক্ষেত্রে বছরে প্রায় ৫৩ লাখ মেট্রিক টন আমদানির কোটা ভারতের কাছে চায় বাংলাদেশ। পণ্যগুলো হচ্ছে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুন। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ কোটা সুবিধা চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে এ প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানি কোটা সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবের বিপরীতে ভারত থেকে এখনো জবাব আসেনি। তবে ভারত সরকারের ইতিবাচক সম্মতি রয়েছে বাংলাদেশের প্রস্তাবের প্রতি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
আমদানির বার্ষিক কোটার মধ্যে চালের পরিমাণ ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে ৮-১০ লাখ এবং বেসরাকরিভাবে ৫-৭ লাখ মেট্রিক টন আমদানির কোটা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া গম আমদানির কোটা সুবিধা চাওয়া হয় ২০ লাখ মেট্রিক টনের, যার মধ্যে সরকারিভাবে ৫ থেকে ৭ লাখ এবং বেসরকারি পর্যায়ে ২০ লাখ মেট্রিক টন। অপর চারটি পণ্যের মধ্যে চিনি ১০ লাখ মেট্রিক টন, পেঁয়াজ ৬ লাখ টন, আদা এক লাখ মেট্রিক টন এবং রসুন ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
মূলত এ কোটা সুবিধা পাওয়া গেলে ভারত যখন-তখন বাংলাদেশে এসব পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারবে না। বাংলাদেশ প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণের এই পণ্য ভারত থেকে আমদানি করতে পারবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোটা সুবিধা ভুটান ও মালদ্বীপকে দিয়ে আসছে ভারত। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন করে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে আমদানির কোটা নির্ধারণ কমিটির প্রধান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক যুগান্তরকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ছয় পণ্য আমদানির কোটার আওতায় সুনির্দিষ্ট চাহিদা নিরূপণ করে প্রস্তাব ভারতের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকার টু সরকার পর্যায়ে এ প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এর আগে একটি কমিটি গঠন করে পণ্যের প্রকৃত আমদানির চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। এরপর সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিপরীতে চাহিদার কোটা ভারতের কাছে চাওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২২-২৩ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উল্লিখিত ৬ পণ্যের আমদানিতে বার্ষিক কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ। তখন ওই প্রস্তাবের মধ্যে গম ৪৫ লাখ, চাল ২০ লাখ, পেঁয়াজ ৭ লাখ, চিনি ১৫ লাখ, আদা দেড় লাখ, ডাল ৩০ হাজার ও রসুন ১০ হাজার মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি তাৎক্ষণিকভাবে পর্যালোচনা করে ভারত।
সেক্ষেত্রে দেখতে পায়, প্রয়োজনের তুলনায় পণ্যের পরিমাণ বেশি চাওয়া হয়েছে। ভারত তখন বলেছিল, পণ্যের পরিমাণ বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়, সাত থেকে আট বছরের বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির রেকর্ড বলে না যে এত পরিমাণ পণ্যের দরকার হবে বাংলাদেশের। ফলে এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভারত কোটা নির্ধারণ করলে পরে প্রয়োজনীয় চাহিদার পর উদ্ধৃত্ত পণ্য থেকে যাবে। এক্ষেত্রে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওই বৈঠকে কোন পণ্য বাস্তবে কত পরিমাণ লাগবে, তা নির্ধারণ করে বাংলাদেশকে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়।
বৈঠক থেকে ফিরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ ও গম রপ্তানি বন্ধ করায় সমস্যা হয়েছিল। দেশের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের প্রধান সরবরাহকারী দেশ ভারতের কাছে তাই এসব পণ্য আমদানিতে বার্ষিক কোটা সুবিধা চাওয়া হয়। আমরা যা চেয়েছি, তা তারা দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু আমরা যদি পরে তা আমদানি না করি, তখন কী হবে-এমন প্রশ্ন করেছে তারা। তিনি আরও বলেছিলেন, উভয় পক্ষকে বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে ভারত। আরও বলেছে, আমাদের যা প্রয়োজন, তা তারা দেবে।
সূত্র জানায়, ভারত থেকে কোনো নিত্যপণ্য আমদানিতে কী পরিমাণ কোটা চাওয়া হবে, সেটি ঠিক করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হককে প্রধান করে জানুয়ারিতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। কমিটিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন থেকে একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়।
এরপর ওই কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিত্যপণ্যগুলোর ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি, আগামী দিনে আরও কী পরিমাণ প্রয়োজন-এসব তথ্য পর্যালোচনা করে ছয় পণ্যের কোটার আওতায় পরিমাণ নির্ধারণ করেছে। তবে ভারতের কাছে ডালের কোটাও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশটির সরকার জানিয়েছে, খেসারির ডাল আমদানির জন্য কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। কারণ, ভারতেই খেসারি ডালের সংকট রয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ নিত্যপণ্য আমদানির একটি অংশ আসছে ভারত থেকে। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ গম আমদানি করা হয়। কিন্তু চলমান যুদ্ধের কারণে এ দুটি দেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। বিকল্প বাজার থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করা সম্ভব হলেও তা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। এ কারণে ভারত থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানিতে আগ্রহী সরকার।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চাল, চিনি, ডাল, আদা, রসুন, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি অংশের চাহিদা পূরণ করা হয় ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে। কিন্তু ভারত নানা পরিস্থিতিতে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে নিত্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে পুরো বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলে। এখন নিত্যপণ্যে ভারত সরকার কোটা সুবিধা দিলে রপ্তানি বন্ধ করলেও এর আওতায় বাংলাদেশ পড়বে না।
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির দ্বিতীয় অবস্থান হচ্ছে ভারত। প্রথম হচ্ছে চীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে ভারত থেকে। এর মধ্যে খাদ্যশস্য হচ্ছে ২২০ কোটি মার্কিন ডলারের। এছাড়া চিনি আমদানি করা হয় ৭৭ কোটি ডলারের। এর আগের অর্থবছরে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা হয় ৮৫৯ কোটি ডলারের। যার মধ্যে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ হচ্ছে ১০০ কোটি ডলারের। শুধু চিনি আমদানি করা হয় ৭০ কোটি ডলারের।
সূত্রমতে, ২৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের বিষয়টি অবহিত করা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্য আমদানির বার্ষিক কোটা সুবিধা নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য বিষয়েও প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বেশকিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।