স্বামী-স্ত্রী দুইজনের নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির দুটি কার্ড থাকলেও দীর্ঘ ৮ বছরে এক ছটাক চাল না মিলায় গত ২৭ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে শোকজ পেয়েছেন মমিনুর-ছকিনা দম্পতি। সম্প্রতি শোকজের জবাবও দিয়েছেন সরকারি সুফল বঞ্চিত এই দম্পতি। উল্টো অভিযোগ তুলে নিতে আপস করার জন্য তদন্ত কমিটি চাপ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।
মনিনুর ইসলাম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মহিষাশ্বর ম্যালম্যালির বাজার এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে। ছকিনা খাতুন তার স্ত্রী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে শোকজ পেলেন দিনমজুর দম্পতি” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যার প্রেক্ষিতে রংপুর অঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তার নির্দেশে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে লালমনিরহাট জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক। তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন, সদর উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক স্বপন কুমার দে আহবায়ক এবং সদস্য হিসেবে রয়েছেন হাতীবান্ধা উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান ও জেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম কাজল। তদন্তের চিঠি পেয়ে বৃহস্পতিবার অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ডিলারসহ সংশ্লিষ্ট ৫জনের লিখিত বক্তব্য গ্রহন করে তদন্ত কমিটি।
অভিযোগে জানা গেছে, হতদরিদ্র শ্রমিক দিনমজুর পরিবারের মানুষদের মাঝে স্বল্প মূল্যে চাল বিক্রি করতে সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করে। প্রথম দিকে ভর্তুকি মূল্যে ১০ টাকা কেজিদরে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে চাল বিক্রি শুরু করে সরকার। পরবর্তীকালে দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজিদর করা হয়। স্থানীয়রা এ কারণে এ কার্ডকে ১০ টাকার কার্ড নামেই জানেন।
অভিযোগ উঠেছে, উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার এনামুল হক ভরসা চালের কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে ২০১৬ সালে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের কাছ থেকে তার ও তার মায়ের পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করেন। পরিচয়পত্র নিয়ে উপজেলা খাদ্য অফিস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড করলেও তা মমিনুর ইসলামের কাছে গোপন রাখেন ডিলার ভরসা। গত ১৮ সালে মমিনুর ইসলামের মা রশিদা বেগম মারা গেলেও তার নামে বরাদ্দের চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন ডিলার এনামুল হক ভরসা।
অপরদিকে গেল বছর সরকার কার্ডধারীদের তথ্য ডিজিটাল করায় বিপাকে পড়েন ডিলার এনামুল হক ভরসা। কারণ কার্ডধারীর আপডেট ছবি ও আঙুলের ছাপ লাগবে। তখন কৌশলে ডিলার এনামুল হক ভরসা মৃত কার্ডধারী রশিদার পুত্রবধূ ছকিনার নামে কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে ছকিনার ও তার স্বামী মমিনুর ইসলামের ছবি ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেন। এরপর মৃত রশিদার স্থলে তার পুত্রবধূ ছকিনার নামে কার্ড তৈরি করেন ডিলার ভরসা। একই সঙ্গে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামের কার্ডের তথ্যও ডিজিটালে হালনাগাদ করে কার্ড দুটি নিজের কাছেই রেখে দেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ডটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে দিনমজুর মমিনুর নিষ্ফল ঘুরেছেন ডিলারের দুয়ারে।
গত মাসের চাল বিতরণকালে উপজেলা খাদ্য বিভাগ ডিলারদের মাঝে কার্ডধারীদের তালিকা নতুন করে বন্টন করেন। এতে শফিকুল ইসলাম নামে এক ডিলারের হাতে পড়ে মমিনুরের স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ড। সেই কার্ডে চাল নিতে আসেন ডিলার এনামুল হক ভরসার দোকানের কর্মচারী নাইম। এতে সন্দেহ হওয়ায় ছকিনা বেগমকে ফোন করেন নতুন ডিলার শফিকুল ইসলাম। তখন মমিনুরের পরিবার জানতে পারে ছকিনার নামে খাদ্যবান্ধবের কার্ড হয়েছে। কার্ড হয়েছে মর্মে স্বীকার করলেও পাঁচ হাজার টাকা না দিলে কার্ড দেবে না বলে সাব জানায় ডিলার এনামুল হক ভরসা। নিরুপায় দিনমজুর মমিনুর ইসলাম অল্প দামে চাল পেতে ডিলার ভরসাকে ঋণে নেওয়া দুই হাজার টাকা দেন কার্ডটি ফেরত পেতে। টাকা নিলেও কার্ড বা চাল কোনোটাই দেননি ভরসা। উপজেলা খাদ্য অফিসে গিয়েও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী দিনমজুর মমিনুরকে সহায়তা করেননি। বরং ডিলার ভরসার বিরুদ্ধে না গিয়ে ভরসার কথামতো চলতে বলা হয়। পরে অন্য মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালুর দিন থেকে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামে কার্ড ও চাল বরাদ্দ ছিল যার কার্ড নম্বর-১৬৯ এবং তার মৃত মা রশিদার পরিবর্তে তার স্ত্রী ছকিনার কার্ড নম্বর-১৪৮০। পরিবারে দুইটি কার্ড থাকার পরেও এক ছটাক চালও কিনতে পারেননি দিনমজুর মমিনুর ইসলাম-ছকিনা দম্পতি।
অবশেষে ২৭ মার্চ তাদের নামে বরাদ্দকৃত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড ও দীর্ঘদিন ধরে আত্মসাৎ করা চাল উদ্ধার এবং অভিযুক্ত ডিলার এনামুল হক ভরসার বিরুদ্ধে বিচার দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মমিনুর ইসলাম। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, সমবায় ও সহকারী প্রোগ্রামারকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন ইউএনও। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিজে আপস করার চাপ দেন বলে দাবি করেন অভিযোগকারী। এতে সম্মতি না দেওয়ায় অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে গত ১৮ এপ্রিল শোকজ পাঠান উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হাসনা আকতার। সেখানে দুই কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিল করতে ব্যর্থ হলে তাদের উভয়ের কার্ড বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এমন অভিযোগে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করে রংপুর আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক।
ভুক্তভোগী মমিনুর ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে আমার পরিবারের নামে দুইটি কার্ড করে বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল আত্মসাৎ করেছেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। এতদিন খাদ্যবিভাগ তা চোখে দেখল না। আমি অভিযোগ দিলাম দুর্নীতিবাজ ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এখন তারা দুর্নীতিবাজকে বাঁচাতে তথ্য গোপন করে না কি আমরা সরকারি সুবিধা আত্মসাৎ করেছি। তাই আমাকে শোকজ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। শোকজের জবাব দিয়েছি। বিচার না পেলে প্রয়োজনে আদালতে যাব। আমার পরিবারের নয়, ১৫৮৩ নম্বর কার্ডটিও ডিলার এনামুলের স্ত্রী ফাতেমার। অনেকের নামে কার্ড করে চাল আত্মসাৎ করছেন ডিলার। তদন্ত করলে বেড়িয়ে আসবে।
তদন্ত কমিটির আহবায়ক সদর উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক স্বপন কুমার দে বলেন, রংপুর আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রকের লিখিত নির্দেশনায় জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশে ৩ সদস্যে গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনা তদন্ত করছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। আপাতত ৫ জনের লিখিত বক্তব্য গ্রহন করা হয়েছে।