বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৪ অপরাহ্ন
শিরোনামঃ
নাটোরে বিএসটিআইয়ের অভিযানে বেকারি কারখানাকে জরিমানা গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ৫৮০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার-২ গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ৫৮০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার-২ শ্রীপুরে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজে বসন্তের আগমনী ধ্বনি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন গাজীপুর মহানগর সভাপতি গ্রেফতার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ! নাগেশ্বরীতে শিশু সুরক্ষা ও সহিংসতা প্রতিরোধ ৩ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের সমাপ্তি গাজীপুর জেলা বিএনপির সংশোধিত আহবায়ক কমিটি ঘোষণ সিরাজগঞ্জে বৃক্ষপ্রেমী শহিদুলের নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছ বিতরণ সিরাজগঞ্জে চাঞ্চল্যকর ডাকাতি ঘটনার রহস্য উদঘাটন!চার ডাকাত আটক

২ লাখ মানুষের জীবন বদলেছে ‘বিদ্যুৎ গতিতে’

রিপোর্টারের নাম : / ৬৭ বার পড়া হয়েছে।
সময় কাল : শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩

বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এখানকার ২ লাখ মানুষের জীবনযাত্রার মানে আমূল পরিবর্তন এসেছে। পাঁচ দশক ধরে এই দ্বীপে বিদ্যুৎ ছিল যেন সোনার হরিণ। এক সময় সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া দ্বীপটিতে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলোকচ্ছটা। কয়েক মাস আগে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের আলো পেয়ে উচ্ছ্বসিত দ্বীপবাসী। বিদ্যুতের কারণে উপজেলার প্রায় সবখানেই আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

আইসক্রিম খেতে কেমন, তা জানত না কুতুবদিয়ার কিশোর রফিক, সেলিম ও আজিজুলরা। কৃষক মঞ্জুর আলমের হাতে মোবাইল এসেছিল আগেই, কিন্তু বিদ্যুৎ ছিল না বলে চার্জ দিতেও পোড়াতে হতো তেল। গত এপ্রিল মাস থেকে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসছে জাতীয় গ্রিড থেকে। আর তাতেই শাহরুখ, মঞ্জুর, রফিকদের জীবন বদলে গেছে ‘বিদ্যুৎ গতিতে’। কয়েক মাস আগেও সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে প্রসূতি মায়েদের নিয়ে যাওয়া হতো চকরিয়া বা কক্সবাজারে। এখন আর সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় না। বিদ্যুৎ আসায় ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে চালু হয়েছে অপারেশন থিয়েটার। এখন প্রসব জটিলতায় সিজারিয়ান অপারেশন হচ্ছে এখানেই। একই সঙ্গে ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট সুবিধা।

উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ—তিন দিকে বঙ্গোপসাগর আর পূর্বে কুতুবদিয়া চ্যানেল। মাঝখানে ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সাগরের বুকে ভেসে থাকা একটি দ্বীপ কুতুবদিয়া। কুতুবদিয়া উপজেলায় হয় লবণ চাষ, সেখানে আছে বাতিঘর, সমুদ্রসৈকত ও কুতুব আউলিয়ার মাজার। সূর্যাস্ত দেখার জন্য কুতুবদিয়া সমুদ্রসৈকতের তুলনা নেই। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত অবস্থিত এখানে। এই সমুদ্রসৈকতের আরো একটি আকর্ষণ হচ্ছে গাংচিল। মাছ চাষের ফলে প্রচুর গাংচিল আসে এখানে। ডানা ঝাপটে গাংচিলের ওড়াউড়ির দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা ভিড় করে সেখানে।

কুতুবদিয়ার বাসিন্দারা জানান, একটা সময় দেশের আর্থসামাজিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। আধুনিক কৃষি, শিক্ষা, চিকিত্সা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন এই দ্বীপে সকল সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করেছে সরকার। বিদ্যুৎ যে কত গুরুত্বপূর্ণ কুতুবদিয়াবাসী এখন বুঝতে পেরেছে। এখন শিল্প-কারখানা, মাছ সংরক্ষণের হিমাগার, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রসার ঘটছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। রাতের আঁধারে সড়কে হোঁচট খেয়ে পড়ার দিনও শেষ। সড়ক বাতি মানুষকে সহজে পৌঁছে দিচ্ছে বাড়িতে। বেড়েছে নিরাপত্তা, কর্মঘণ্টা। দ্বীপে উৎপাদিত সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, লবণ, তরমুজ, পানসহ নানা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে। দ্রুত প্রসার ঘটবে পর্যটনের—এমনটাই আশা দ্বীপবাসীর।

বিদ্যুৎ বরাবরই কুতুবদিয়ার মানুষের কাছে স্বপ্ন ছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষের কথা শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া কেউ ভাবেননি। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশের শত ভাগ মানুষকে বিদ্যুত্সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছে গেছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ। এতে এলাকার মানুষ অনেক খুশি। বিদ্যুৎ আসায় দ্বীপের চেহারা পালটে যাচ্ছে।

কুতুবদিয়ার প্রাণকেন্দ্র বরঘোপ বাজার: কুতুবদিয়া কক্সবাজারের উপজেলা হলেও চট্টগ্রাম থেকেই যোগাযোগ সুবিধাজনক। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে বাসে করে চকরিয়া হয়ে মগনামা ঘাটে যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে করে কুতুবদিয়া যেতে লাগে ৪৫ মিনিট। ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোটে গেলে ১৫ মিনিটে যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে করেও সরাসরি কুতুবদিয়া যাওয়া যায়, তাতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, সেই লঞ্চ চলে দিনে একবার। উপজেলা সদর বরঘোপ বাজার হলো কুতুবদিয়ার প্রাণকেন্দ্র। সেখানে কথা হলো চান্দের গাড়ির চালক নুরুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার বাড়িতে তার টানা হয়েছে, তবে এখনো বিদ্যুৎসংযোগ লাগেনি। তার পরও তিনি ভীষণ খুশি।’ মনোয়ারখালী গ্রামের কৃষক মঞ্জুর আলম বলেন, ‘আগে তেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চার্জ দিতাম। তেল না থাকলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ দেওয়া লাগত। এখন আমার ঘরেই বিদ্যুৎ আছে।’ আরস সিকদারপাড়ার ৬৪ বছর বয়সি বজল করিমের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে মাসখানের হলো। তিনি বলেন, ‘আগে সোলার দিয়ে লাইট জ্বালাইতাম। এখন আমার বাড়িতে রাইসকুকার দিয়ে ভাত রান্না হয়। ফ্রিজ কিনেছি। সমুদ্রের মাছ রেখে খেতে পারি।’

যেভাবে গেল বিদ্যুত্ :ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় প্রায় ২ লাখ মানুষের বসবাস। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিংসহ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে ২ কিলোমিটার বিতরণ লাইন।

ক্ষুদ্র শিল্প করার দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে: বিদ্যুৎ আসার পর কী কী পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা ইত্তেফাককে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এখানে বিদ্যুৎ ছিল না। গত এপ্রিলে বিদ্যুৎ আসার পর এই এলাকার মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র শিল্প করার দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মত্স্য ও বরফ শিল্পের অনুমোদনের জন্য যোগাযোগ করছে এখানকার লোকজন।’ কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের বড়ঘোপ বাজারে ব্যবসায়ী করিম উদ্দিন বলেন, ‘কুতুবদিয়ার মানুষের স্বপ্ন পূরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কুতুবদিয়ায় বিদ্যুত্ আসবে কখনো ভাবিনি। ১২ এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। আমাদের জীবন পালটেছে বিদ্যুৎ গতিতে। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ।’

কম্পিউটারে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে খুশি শিক্ষার্থীরা: কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল আলমের বাড়িতে রাত থেকে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। ঘরের লোকজন রঙিন টেলিভিশনে খবর দেখছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় এত দিন ঘরে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার ভালো সুযোগ পায়নি। এখন কম্পিউটারে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। উপজেলা সদরের মৎস্য ব্যবসায়ী জালাল আহমদ বলেন, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ হাতে আসায় অন্তত ৩৪ হাজার মৎস্যজীবী লাভবান হবেন। ইতিমধ্যে তিনিসহ কয়েক জন ব্যক্তি মৎস্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় এত দিন এলাকায় আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ, পোলট্রি, মৎস্য খামার, শিল্প-কলকারখানা, কুটিরশিল্প গড়ে উঠেনি জানিয়ে কুতুবদিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, করোনা মহামারির সময় সারা দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস, পাঠদান ও পরীক্ষায় অংশ নিলেও কুতুবদিয়ার শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। দ্বীপের একমাত্র ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে রাতে কয়েক ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে চিকিৎসাসেবা চালানো হতো। জেনারেটর নষ্ট কিংবা বিকল হলে মোমের আলোয় চলত নানা চিকিৎসা। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বিদ্যুতের আলো পাওয়াকে স্বপ্নপূরণের মাইলফলক মন্তব্য করেন দ্বীপের বাসিন্দারা।

আলোকিত কুতুবদিয়ার প্রতিটি আনাচে-কানাচে: কুতুবদিয়ায় শাহ আলম নামক স্থানীয় এক কবি কবিতার ভাষায় বলেন, ‘বিদ্যুতের আলোয় হারিয়ে গিয়েছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকার রাস্তায় ভরা বর্ষায় কাদামাটিতে পিছলে পড়ার ঘটনা আর শোনা যায় না। আলোময় জীবন এসে ঘুচিয়ে দিয়ে গেছে অন্ধকারের সব কারসাজি। প্রতিটি ঘর ভরে গেছে বিদ্যুতের আলোয়। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত আজ কুতুবদিয়ার প্রতিটি আনাচে-কানাচে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর

এক ক্লিকে বিভাগের খবর