সন্ত্রাসের দায়ে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক-২ শাখা থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জানানো হয়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গসংগঠনের বিবৃতিও এখন নিষিদ্ধ। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন বা ব্যক্তির কোনো বিবৃতি, মন্তব্য, অভিমত, উক্তি কোনোভাবেই প্রচার-প্রকাশ করা যাবে না।’
জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট দেওয়া রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতে ইসলামীর পাওয়া নিবন্ধন বাতিল করেন। যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রেখেছেন এবং যেহেতু সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবির সামপ্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল, যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত, সেহেতু সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ধারা ১৮(১) অনুযায়ী ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরসহ সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করল। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে।
গতকাল এই প্রজ্ঞাপন জারির পর সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দলটির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। আপিল বিভাগে গিয়েও তারা নিবন্ধন ফিরে পায়নি।
সর্বশেষ কোটাবিরোধী আন্দোলনে তারা সরাসরি এবং বিভিন্ন ধরনের উসকানি দিয়ে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যুদ্ধাপরাধের রায়, নিবন্ধন বাতিলের রায় এবং বর্তমান কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে জামায়াত এখন আর কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এখন তারা নিষিদ্ধ সংগঠন। এই গেজেট চলমান থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে আইন অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারির পর সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বত্র পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় নাশকতার বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) হাবিবুর রহমান।
নিষিদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো সহিংসতা হলে তা দমনের সক্ষমতা সরকারের রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল সন্ধ্যায় জামায়াত-শিবির ও এর অঙ্গসংগঠনকে ‘নিষিদ্ধ সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ হুঁশিয়ারি দেন।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছি। ওদের বিরুদ্ধে আমরা সেই একাত্তর থেকে যুদ্ধ করছি। সুতরাং এগুলো দমনে আমাদের সক্ষমতা অনেক আছে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সামপ্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সমপৃক্ত থাকার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একই অপরাধে তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
নিষিদ্ধ হওয়ার পর জামায়াতের সম্পদের কী হবে—এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইন অনুযায়ী সেগুলোর ব্যবস্থা হবে।’
দল হিসেবে নিষিদ্ধের পর জামায়াত-শিবিরের সদস্যদের কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এই দলের আন্ডারে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু এটা যদি আপনারা বলেন, গণহারে যারা জামায়াত ইসলামীর নতুন কর্মী হয়েছেন, ১৯৭১-এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন, তাদের বিচার করা হবে, এ রকম গণহারে বিচার করা হবে না। তবে তারা যদি বাংলাদেশের কোনো আইনে অপরাধ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হবে।’
নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে কি না—এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, নকশালবাদীসহ অনেক দলের কী হয়েছে, সেটার ইতিহাস আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের নেতকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে সারা দেশে এর মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্ত হয়। গত মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে, যা গতকাল জারি হয়েছে।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলও ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ হয়ে যায়। জামায়াতের নিবন্ধন না থাকলেও এত দিন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। অবশ্য এর আগে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তিনবার তারা নিষিদ্ধ হয়।
১৯৫৯ সালে সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পাকিস্তানে প্রথমবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৪ সালে মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতার কারণে জামায়াতকে আবার নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে জামায়াতসহ সব ধর্মভিত্তিক দল, সংগঠনের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়।