সঞ্চয় ভাঙার প্রবণতা কিছুটা কমছে
মেয়াদপূর্তির আগেই আমানত ভাঙানো কিংবা নিজের সঞ্চয় হিসাব থেকে টাকা তুলে রাখছিল মানুষ। গ্রাহক চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে নগদ ২২শ কোটি টাকা করে নিচ্ছিল ব্যাংকগুলো। তবে গত কয়েকদিন ধরে সঞ্চয় ভাঙিয়ে কাছে রাখার প্রবণতা কমেছে। যে কারণে অনেকদিন পর মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে ফিরেছে ৯৩১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখার প্রবণতা বাড়তে শুরু করে গত অক্টোবরের পর। অক্টোবর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত ব্যাংক থেকে তুলে হাতে রাখা টাকার পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সব মিলিয়ে এখন মানুষের হাতে রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। আর দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভল্টে রয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর আগে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকের ভল্টে ১৩ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা থাকত। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে এসে কেউ যেন ফিরে না যায় সে জন্য ভল্টে মজুত বাড়িয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ সময়ে প্রচুর নতুন নোট ছেড়েছে। চাপ সামলাতে পুরোনো ও দাগযুক্ত নোটও ছাড়া হয়েছে বাজারে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্টে (অন্য ব্যাংকের সীমার অতিরিক্ত টাকা রাখার ভল্ট) রয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত চেস্টগুলোতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি থাকে। সব মিলিয়ে এখন ছাপানো টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত অক্টোবর শেষে যা ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ছিল।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বর্তমানে ব্যাংক খাতে সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এর বিপরীতে ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা। তবে সব টাকা নগদ আকারে থাকে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যে ২২ হাজার কোটি টাকা রয়েছে এর মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা পোড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে। আর ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো রয়েছে যা পুরোনো, অধিক ময়লাযুক্ত বা অতিরিক্ত দাগানোর কারণে অপ্রচলিত হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ‘নন-ইস্যু’ হিসেবে জমা দেওয়া এসব নোট বাছাই করে কিছু আবার প্রচলনে দেওয়া হয়। তবে এবারের সংকট মেটাতে বাছাই না করেই পুরোনো ও দাগানো নোট বাজারে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আবার নতুন নোটও ছাড়া হয়েছে প্রচুর।
জানা গেছে, গত সোমবার পর্যন্ত রেকর্ড ২ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের বাইরে ছিল। গত বৃহস্পতিবার যা ২ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা ছিল। আর গত ৮ ডিসেম্বর ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। গত কোরবানি ঈদের আগে প্রচলনে দেওয়া নোটের পরিমাণ উঠেছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। তবে ঈদের পর জুলাই শেষেই তা ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার নিচে নামে। সেখান থেকে প্রতি মাসে কমতে কমতে অক্টোবর শেষে যা ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকায় নামে। তবে এবার নানা কারণে তৈরি হওয়া উদ্বেগে মানুষ টাকা তুলে ঘরে রাখছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আমানতকারীদের একটা অংশ উদ্বিগ্ন হয়ে হঠাৎ করে টাকা তুলে ঘরে রাখছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে জালিয়াতি। গত ১২ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই দুই ব্যাংকসহ চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কর্তৃত্বে পরিচালিত এসআইবিএল, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের দৈনিক ভিত্তিতে তথ্য নেওয়াসহ তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এসব কারণে গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ এখন কমছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে গত সেপ্টেম্বরে। গত অক্টোবর মাসে সমকালসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারণার কারণে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে টাকা তুলছিল। এভাবে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখা কোনো সমাধান নয়। মানুষ এটি বুঝতে পেরে আবার ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া শুরু করেছে। তিনি বলেন, ব্যাংকে জমা থাকা টাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে বারবার আশ্বস্ত করেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। এসব কারণে মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, কী পরিমাণ টাকা ছাপানো হবে বছরের শুরুতে তার একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কালি, কাগজ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা হয়। সাধারণত ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে নতুন নোট ছাড়া হয়। তবে সম্প্রতি কোনো উৎসব ছাড়াই নগদ টাকার ব্যাপক চাহিদার কারণে জমানো বেশিরভাগ নোট বাজারে ছাড়া হয়েছে। এতেও কুলাতে না পেরে অনেক পুরোনো নোট আবার প্রচলনে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গাজীপুরের টাঁকশালে টাকা রাখার মতো জায়গা থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টেও টাকা উপচে পড়ে। যে কারণে টাকা ছাপানো মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে। তবে গত অক্টোবরের পর ঘটছে ভিন্ন ঘটনা। ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টেই টান পড়তে শুরু করে। মাঝে কয়েকদিন ‘অপ্রচলিত’ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে জমা থাকা নোট আবার ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ইসলামী ব্যাংকের বিতর্কিত ঋণের বিষয়টি সামনে আসার আগ থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছিল। বিশেষ করে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে আলাদা তদারকির ঘোষণা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থায় কিছুটা চিড় ধরে। এসবের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে পারবে না- এমন অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা তুলে ঘরে রাখা শুরু করে। মেয়াদপূর্তির আগেই ডিপিএস বা এফডিআর ভেঙে নিচ্ছিলেন অনেকে। সাধারণ নিয়মে টাকা তুলে খরচ করলে কোনো না কোনো উপায়ে আবার ব্যাংকে ফেরত আসে। তবে কিছুদিন ধরে অনেক ক্ষেত্রে ফেরত না আসায় নগদ টাকার ওপর চাপ তৈরি হয়।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাফর আলম বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে- এমন নেতিবাচক প্রচারণার মধ্যে বৈশ্বিক মন্দার বিষয়টি সামনে আসে। এর মধ্যে একটি গ্রুপ গুজব ছড়ানো শুরু করে, ব্যাংকের কাছে টাকা নেই। এসব কারণে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছিলেন। তবে যে কোনো মানুষের জন্য অনেক দিন ধরে ঘরে টাকা রাখা অনিরাপদ। যে কারণে এখন আবার টাকা ফেরত আশা শুরু হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ. খান বলেন, সঞ্চয় নিরাপদ রাখতে ব্যাংকেই টাকা রাখতে হবে। নিজের কাছে টাকা রাখা কোনো সমাধান নয়। তবে মানুষের আস্থা ধরে রাখতে সুশাসনের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব রয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংকে জমানো সব টাকা কখনও একবারে গ্রাহক উত্তোলন করেন না। এ বিষয় বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ছাপে। কোরবানির ঈদের আগে টাকা তোলার চাপ বাড়লেও ঈদের পরই বড় একটি অংশ আবার জমা হয়। আর একটি পরিমাণ কোনো না কোনো উপায়ে ব্যবসা বা নিজের প্রয়োজনে মানুষের কাছে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ করে অনেক বেশি টাকা মানুষের হাতে আটকা পড়লে নগদ টাকার ওপর একটি প্রভাব পড়ে।