সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন

সন্দেহভাজন জঙ্গির জামিন বাতিল ও হাইকোর্টের বার্তা

রিপোর্টারের নাম : / ১১৫ বার পড়া হয়েছে।
সময় কাল : বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য শোয়াইব আহমদের জামিন প্রত্যাহার করেছেন হাইকোর্ট। এক প্রতিবেদন অনুসারে, মঙ্গলবার এ আদেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। উচ্চ আদালতের এ আদেশটি শুধু সাধুবাদযোগ্য নয়, তাৎপর্যপূর্ণও বটে।

প্রতিবেদন মতে, গত বছরের ২৮ আগস্ট ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তারের পর শোয়াইবসহ দু’জনের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে মামলা করেছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। নিম্ন আদালতে জামিন না পেয়ে হাইকোর্টে আসেন শোয়াইব; গত ২০ নভেম্বর ওই আদালত থেকে জামিনও পেয়ে যান তিনি। এ জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য আদালতে নোট দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। এরই মধ্যে মঙ্গলবার হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ জামিনাদেশটি প্রত্যাহার করেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির আগেই আদালত তার আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন।

আদালতের সিদ্ধান্তটিকে রিঅ্যাক্টিভের বদলে প্রোঅ্যাক্টিভ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তা ছাড়া এমন পদক্ষেপ এর আগে কখনও ঘটেনি এমন নয়; তবে জঙ্গিবাদে অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে সম্ভবত এটাই প্রথম। সিদ্ধান্তটিকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হওয়ার কারণটিও এখানেই নিহিত।

লক্ষণীয়, শোয়াইবের জামিনাদেশ প্রত্যাহারের ঘটনাটি ঘটার মাত্র দু’দিন আগে পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় তাঁর সহযোগীরা। স্বাভাবিকভাবেই তা দেশব্যাপী তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করার পাশাপাশি এ ধারণারও জন্ম দেয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও জঙ্গিদের যে কোনো কিছু করার সক্ষমতা এখনও কম নয়; সর্বোপরি, জঙ্গিবাদ এমন একটি ভাইরাস, যা যে কোনো সময় চাড়া দিতে পারে; অতএব তাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক মুহূর্তও ঢিলেমির সুযোগ নেই। আমরা জানি না, আদালতপাড়ার ওই জঙ্গি ছিনতাই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শোয়াইবের জামিনাদেশ প্রত্যাহারের মতো সতর্কতামূলক ঘটনাটি ঘটেছে কিনা; তবে এর মাধ্যমে উচ্চ আদালত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহিষ্ণুতার সর্বজনীন নীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এমন কথা নির্দি্বধায় বলা যায়।

বলা হতে পারে, শোয়াইব গুরুতর কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে প্রমাণ নেই; রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ একটা সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে র‌্যাব অভিযোগ করেছে বটে, তবে তা এখনও আদালতে প্রমাণিত হয়নি; অতএব দেশের সংবিধান এবং আইনের শাসন মানলে বলতে হবে, জামিন পাওয়াটা তাঁর অধিকার। তবে এটাও ঠিক যে, জঙ্গিবাদ এমন একটা মতবাদ, গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে যার দূরতমও কোনো সম্পর্ক নেই; বরং গণতন্ত্রকে হত্যা করাই এমন আদর্শধারীদের ঘোষিত লক্ষ্য। এ কারণে বলা হয, জঙ্গিবাদকে সামান্যতম স্পেস দেওয়া মানে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজের পায়েই কুঠার মারা। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের বহু দেশে তো বটেই বাংলাদেশেও এর সপক্ষে ভূড়ি ভূড়ি প্রমাণ আছে; বিশেষ করে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার পর এ নিয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। অতএব কারও বিরুদ্ধে এ মতবাদ প্রচার শুধু নয়, লালনের অভিযোগ থাকলেই তাকে আর দশটা ফৌজদারি অপরাধ সংঘটকের চেয়েও বেশি সন্দেহের চোখে দেখতে হবে।

বলা বাহুল্য, আইনের চোখে সবাই সমান- কথাটা সাধারণভাবে সত্য হলেও আমাদের দণ্ডবিধিতেই বলা আছে কোন ধরনের অপরাধী জামিন পাবে আর কে পাবে না; অর্থাৎ এখানে ইক্যুয়ালিটির (সাম্য) চেয়েও ইক্যুইটির (ন্যায্যতা) ধারণাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে বলা যায়, জঙ্গিবাদের দায়ে গ্রেপ্তার কারও জামিন পাওয়ার অধিকারটি একটু বেশি সময়ের জন্য স্থগিত রাখার বিষয়টি মোটেও সংবিধান বা আইনবিরোধী কিছু নয়।

শোয়াইবের জামিনাদেশ প্রত্যাহার করে আদালত এ বার্তাটিও সম্ভবত দিতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদের মোকাবিলা করতে হবে। বাস্তবেও কিন্তু কথাটা সত্য।

রোববারের জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটাই স্মরণ করুন। যদি জেলখানায় জঙ্গিদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হতো, তাহলে ওই ছিনতাই পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে ছিনতাইকৃত জঙ্গিদের যোগাযোগ সম্ভবপর হতো না। আবার পুলিশের যে বিভাগের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ায় তারাও কিন্তু যথেষ্ট সতর্ক ছিল না। এমনকি এর আগে অন্তত দুইবার একই ধরনের জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার পরও তাদের হুঁশ হয়নি। আর এ ধরনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অন্য মামলায় অহরহ সাধারণ অপরাধীদের মতো সশরীরে আদালতে হাজির করতে হবে কেন? এদের জন্য কি ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা করা যেত না? এখানে নিম্ন আদালতও তাদের দায় এড়াতে পারে না বলে আমার মনে হয়।

জঙ্গিবাদ দমনের প্রশ্নে সংশ্নিষ্ট সব সরকারি সংস্থার দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি এদের মধ্যে সুসমন্বয়ের বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে শুধু বিপদ মোকাবিলাই কঠিন হয় না; একটা সংস্থার কঠোর পরিশ্রমও শেষমেষ বিফলে যেতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে, লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক দীপন হত্যাকারীদের বিচারে অর্ধযুগেরও বেশি সময় লেগেছে; খুনিদের গ্রেপ্তারেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বহু পরিশ্রম করতে হয়েছে। এত সময় ও শ্রমের ফল কিছু সংস্থার দায়িত্বহীনতার জন্য আজ ব্যর্থ হতে চলেছে; শুধু তা নয়, এ ভয়ংকর জঙ্গিরা বাইরে থাকা মানে আরও বহু অভিজিৎ বা দীপনের প্রাণ খোয়ানো; এমনকি আরেকটা হলি আর্টিজানের শঙ্কা তৈরি হওয়া।

শেষ কথা হলো, সন্দেহভাজন জঙ্গিকে কারাগারে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে উচ্চ আদালত তাঁর আন্তরিকতা দেখিয়েছেন; এখন পালা অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলতা প্রদর্শনের।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর

এক ক্লিকে বিভাগের খবর