হুন্ডি বন্ধে কঠোর সরকার
হুন্ডি ঠেকাতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা চালু। সেই সঙ্গে হুন্ডি বন্ধে একাধিক গাইডলাইন প্রদান করা হয়েছে। গাইডলাইনগুলো হলো- প্রবাসীদের যথাযথ ইকেওয়াইসি মেনে এমএফএস অ্যাকাউন্ট খোলা; বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর সঙ্গে এমএফএস কোম্পানির চুক্তি করা। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়বে। চলমান ডলার সংকট কেটে যাবে। স্বাভাবিক হবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে মঙ্গলবার এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সধারী এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে রেমিট্যান্স দেশে আনার জন্য বিদেশি অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার, ব্যাংক, ডিজিটাল ওয়ালেট, কার্ড স্কিম ও এগ্রিগেটর পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগ্রহী এমএফএস প্রোভাইডারদের প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন পেতে চলতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। প্রবাসীদের অর্থ প্রথমে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হবে। আর এটি জমা হবে প্রবাসীর মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে টাকার অঙ্কে। এজন্য বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের যথাযথ ইকেওয়াইসি পরিপালন করে এমএফএসে হিসাব খুলতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারদের সেটেলমন্টে অ্যাকাউন্ট সুবিধা দেবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লাইসেন্সধারী এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা তাৎক্ষণিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন। এত দিন বিদেশি কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এনে সেই অর্থ গ্রাহকের মনোনীত ব্যক্তির কাছে পাঠানো হতো। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়ার আশা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে বছরে পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করার ফলে এ পরিমাণ অর্থ বৈধ পথে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসবে। ফলে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের বাজার স্থিতিশীল হবে। ডলারের বিনিময় মূল্যে ভারসাম্য আসবে। সহজ হবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রবাসীরা। যোগাযোগ করা হলে সিঙ্গাপুরপ্রবাসী রেজাউর রহমান গতকাল বলেন, দেশে অর্থ পাঠানো সহজ করার পাশাপাশি ডলারের বিনিময় মূল্যও বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য ডলারের মূল্য ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা, সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা। অন্যদিকে হুন্ডিতে ডলারের মূল্য প্রায় ১১৪-১১৫ টাকা। যে কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিতেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘আমাদের আশা, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগে প্রবাসীরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করেই নিরাপদে এবং আরও দ্রুত বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন, যা রেমিট্যান্স গ্রহণে আরও গতিশীলতা আনবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসারেই পরবর্তী সব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হবে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, হুন্ডি ঠেকাতে এটি সরকারের সময়োপযোগী উদ্যোগ। প্রবাসীরা সহজে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ পাবেন। এখন থেকে আর তারা হুন্ডিতে অর্থ পাঠাবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে সাহায্য করবে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রবাসীদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা অনেক আগেই চালু করা উচিত ছিল। হুন্ডি ঠেকাতে মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রহণের অনুমতি দেওয়ায় প্রবাসীরা সহজেই টাকা পাঠাতে পারবেন। কারণ ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠাতে অনেক সমস্যা। খরচ বেশি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। এমএফএস কোম্পানিগুলো রেমিট্যান্স সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়ায় হুন্ডি কমে যাবে। বাংলাদেশ এমএফএস সেবা প্রথম চালু হয় ২০১১ সালে। বর্তমানে দেশে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এমএফএস সেবা দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক অ্যাকাউন্ট ১৮ কোটির বেশি এবং এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সরকারের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮৭ জন শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে গেছেন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জন। চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৯০ হাজার শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও আগের মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে অক্টোবরে। অক্টোবরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৫২ কোটি ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১২ কোটি ডলার কম। সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ১৬৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার।