দলেই বেশি মনোযোগ শেখ হাসিনার

বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে দলের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে আওয়ামী লীগকে তেমন ভাবতে হয়নি। কিন্তু এবারের সংসদ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করতে দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, দলের শক্তি-সামর্থ্যকে এবার বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নির্বাচনে জিততে দলের ওপরই বেশি ভরসা করছেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। এ জন্যই নির্বাচনের আগে শেষ কয়েক মাসে যেকোনো মূল্যে দলের হারানো জৌলুস ফেরাতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন তিনি।
টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সংকটাপন্ন পরিস্থিতি পার করছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ এখন সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের দলে পরিণত হয়েছে। সুবিধাভোগীদের দৌরাত্ম্য দলের আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করা পুরনো নেতারা কোণঠাসা হয়ে গেছেন। পাওয়া না পাওয়ার কষ্ট দলের সঙ্গে অনেকেরই দলের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দ্বন্দ্ব-কোন্দল আওয়ামী লীগকে জৌলুসহীন সংগঠনে পরিণত করেছে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ও অন্য আরও নানাভাবে করা তদন্তে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের জরাজীর্ণ অবস্থার চিত্র। দলের এ অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদের মোকাবিলা করা, বিজয় ছিনিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে উঠবে আওয়ামী লীগের জন্য। তাই দলকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করতে বেশ মনোযোগ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা বলেন, তারা জানেন যে, নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে নানা ধরনের আরও ডালপালা গজাবে। এগুলো মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করে তুলতে না পারলে ভোটে বিরূপ প্রভাব পড়বে। শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে তারা জানান, আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের ভূমিকা বেশি। তাই দলের সর্বস্তরের সবাইকে এখন অন্য সবকিছু ভুলে যেতে হবে। ওই নেতারা মনে করেন, দল শক্তিশালী না হলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায় না। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দলের ঐক্য জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে দলীয় সভাপতির আমন্ত্রণে আমরা কয়েকটি জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক গণভবনে যাই। শেখ হাসিনা আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, দলকে শক্তিশালী করতে হবে, সব রাগ-ক্ষোভ ভুলে যেতে হবে। শুধু একটাই মাথায় রাখতে হবে, দলকে ক্ষমতায় আসতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ধরেই নিয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি অনেকের অসহযোগিতার মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগকে। তাই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলের শক্তির ওপর জোর দিচ্ছেন। দেশি-বিদেশি অসহযোগিতা থাকার পরও দলের ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ সভাপতি আরেকটি চমক দেখাতে চান। কিন্তু দলে অনৈক্য ও ভুল বোঝাবুঝি যে অবস্থায় আছে তাতে নির্বাচনে দলের কাক্সিক্ষত ভূমিকা পাওয়া অনিশ্চিত।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন ঘিরে নানা ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও বিদেশি অবস্থানে দল কিছুটা বিচলিত। ফলে কারও কোনো সহযোগিতা প্রত্যাশা না করে দলের ওপর ভরসা করতে চান আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য অনেকটা হতাশার সুরেই বলেন, গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের ‘ডিপ্রাইভ’ (বঞ্চিত) নেতাকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, এখন কর্মসূচিতে নেতাকর্মী কম আসতে শুরু করেছে, দলীয় কার্যালয়েও নেতাকর্মীর উপস্থিতি হাতেগোনা।
সভাপতিমণ্ডলীর ওই সদস্য বলেন, “আমরা প্রত্যেকেই যে যেখানে দলের দায়িত্ব ও পদে আছি সবার আলাদা একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এ যে অবস্থা সেটা আমাদের জানা থাকলেও বলয় সৃষ্টি করা ওই অংশই পদ পেয়েছে, এমপি, মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে বারবার। দলকে চাঙ্গা না করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার অপরাধে শাস্তি না পেয়ে বরং সবকিছুই ঠিকঠাক রাখতে পেরেছেন তারা। ফলে ‘ডিপ্রাইভ’ হওয়া নেতাকর্মীরা আরও হতাশ হয়েছেন।”
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ওপর যে বেশি নির্ভর করছেন সেটা তার সাম্প্রতিক সময়ের কর্মকাণ্ড দেখেই বোঝা যায়। এরই অংশ হিসেবে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করা ও ‘ডিপ্রাইভ’ নেতাদের হতাশা দূর করার লক্ষ্যে প্রথমে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে ঢাকায় ডেকে গণভবনে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছেন। এরপর উপজেলা-থানার নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। যেসব এলাকায় সমস্যা রয়েছে প্রয়োজনে সেখানেও যাবেন দলীয় সভাপতি। ইতিমধ্যে একাধিক জেলা সফরও করেছেন তিনি।
সম্পাদকমণ্ডলীর ওই সদস্য বলেন, বৈঠক করে দলের নেতাকর্মীদের চার নির্দেশনা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দেওয়া, সরকারের উন্নয়নের প্রচার বাড়ানো, জনসংযোগ করা, যেকোনো মূল্যে সংগঠন শক্তিশালী ও সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, দলের প্রধান মনে করেন, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের ভীষণ প্রয়োজন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী ঈদের ছুটিতে জনসংযোগের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের উপকারভোগীদের খোঁজখবর নিতে বলেছেন। গত বুধবার ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক যৌথসভায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে ঈদে কার কী দায়িত্ব পালন করা উচিত সে নির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন।
ওই সভায় উপস্থিত থাকা কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দলীয় সভাপতি মূলত পাঁচ-ছয়টা নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন জমি অনাবাদি রাখা যাবে না। যার জমি আছে তাকে উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপির আমলের অপশাসন দুর্নীতি চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি) উদ্দেশ্য বলেছেন, এলাকায় কোনো গ্রুপিং করা যাবে না, কোনো কোন্দল সৃষ্টি করা যাবে না। সবাইকে কাজ করতে হবে। মনোনয়ন দেবেন তিনি। যারা এলাকায় কাজ করতে চান একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিতায় জড়ানো যাবে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদেরও সারা দেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসে তাদের দুঃখ-কষ্ট শোনা ও সমাধান করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভাপতি। পাশাপাশি তৃণমূল নেতাদের চাওয়া-পাওয়াকে ভোটের আগ পর্যন্ত গুরুত্ব দিতেও বলেছেন তিনি। এ ছাড়া দলীয় নেতাদের সাদাসিধে জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, দলকে সংগঠিত করা, ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তৃণমূল নেতার সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ধারাবাহিক এই বৈঠক চলবে নির্বাচন পর্যন্ত।
দলের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে দলকে সংগঠিত করা, দলের ঐক্য ফেরানোর জন্য কার্যক্রম শুরু করেছেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা।