পদোন্নতি পাচ্ছে না দুর্নীতিবাজরা
প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আর পদোন্নতি নয়। সৎ-দক্ষ ও মেধাবীদের পদোন্নতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। পদোন্নতির তালিকায় থাকা সরকারি কর্মকর্তারা দুনীতির সাথে জড়িত কি না তা যাচাই-বাচাই করা হতে পারে। গত বৃহষ্পতিবার সচিব সভায় একাধিক সচিব এমন সুপারিশ করার পরে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)-সভায় বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোন ধরনের অনুকম্পা দেখানো হবে না। এছাড়াও বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি, গ্রেড-৩) পদ, বিসিএস (কর) ক্যাডার রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর) (গ্রেড-২) পদ পদোন্নতি ক্ষেত্রে অধিকতর যাচাই শেষে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে তিনবার পদোন্নতি বঞ্চিত এমন কর্মকর্তাদের বিবেচনায় আনা নাও হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সুপিরিয়র সিলেকশন বোড (এসএসবি)’র সভায় ৫টি ক্যাডার পদে পদোন্নতি নিয়ে আলোচনা হয়। এগুলো হচ্ছে. বিসিএস (কর) ক্যাডারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর) (গ্রেড-২) পদে পদোন্নতি, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের অধ্যাপক, প্যাথলজি (গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি (গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের অধ্যাপক, পেডিয়াট্রিক (গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি, বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি, গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি এবং জনপ্রশাসনের বিবিধ বিষয়।
জানা গেছে, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের অন্তত চারটি ব্যাচের অতিরিক্ত ডিআইজি পদের কর্মকর্তারা ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিবেচনায় আনা হচ্ছে। এজন্য অনেকেই জোর তদবির শুরু করেছেন। এর আগে এসএসবির কয়েক দফায় সভা অনুষ্ঠিত হলেও পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে সুরাহা হয়নি। শুধু পুলিশ ক্যাডার নয়, স্বাস্থ্য, কর ক্যাডারের বিষয় সুরাহা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে নীতিনির্ধারকরা। পদোন্নতির ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ব্যক্তি সখ্যতা বা অন্য কোন প্রভাবে কাউকে সভায় প্রধান্য দেওয়া হবে না। সৎ. দক্ষ ও মেধাবীদের পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের ডিআইজি পদোন্নতি নিয়ে গোটা পুলিশ প্রশাসনে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। পদোন্নতি প্রত্যাশী কয়েক ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও এসএসবির সদস্যদের কাছে কর্মকর্তাদের তদবির ও দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক মাসে এসএসবির সভা কয়েক দফা হলেও পুলিশের পদোন্নতির বিষয়টি চুড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে এবার চুড়ান্ত করার লক্ষ্যে এসএসবির সভার কার্যসূচিতে পুনরায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সচিব সভায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও এ নিয়ে সচিবদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। সভায় একাধিক সচিব বলেছেন, আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী এসব তথ্য গোপন থাকবে। তিনজন সচিব বলেন, স্ত্রীদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। তবে প্রত্যেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব বিবরণী জমা দেবেন। এই তথ্য কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে হবে। জনগণের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। অন্য এক সচিব বিদেশি প্রকল্পের নামে সরকারি কর্মকর্তারা যে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন, তা পুরোপুরি বন্ধ করার ব্যাপারে প্রস্তাব দেন। এর ফলে মূল্যবান সময় এবং অর্থ অপচয় রোধ করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। সভায় প্রস্তাব দেওয়া হয়, শুদ্ধাচার পুরস্কার ফেরত নেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিতে জড়ালে তার পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হবে। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও ভালো জায়গায় বদলী করা যাবে না। এ জন্য নীতিমালা সংশোধন করা দরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে ডিআইজি পদ রয়েছে ৮৭টি। এর মধ্যে মাত্র ১১টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া আগে থেকেই সুপার নিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) ৬৫টি পদ অনুমোদন হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ৭৬ কর্মকর্তাকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া যাবে। অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে ডিআইজি পদে পদোন্নতির যোগ্য বিভিন্ন ব্যাচের (১৮ ব্যাচ, ২০ ব্যাচ, ২১ ব্যাচ ও ২২ ব্যাচ) কর্মকর্তা রয়েছেন ১৩০ জনের বেশি।
পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় থাকছেন বিসিএস ২০ ব্যাচের ৬০ কর্মকর্তা ২১ ব্যাচের ৩৭ কর্মকর্তা, ২২ ব্যাচের ৩০ কর্মকর্তা ও পদোন্নতি বঞ্চিত ১৮ ব্যাচের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় পুলিশের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপ ও তদবির অব্যাহত রেখেছেন। ২০ ব্যাচের পদোন্নতিপ্রত্যাশী কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা পদোন্নতি নিশ্চিত করতে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন।
তবে পদোন্নতির আগে কোন কর্মকর্তার বাড়ি কোন অঞ্চলে, কোন কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় কী এবং কে কার লোক নিজেদের মধ্যে এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেক কর্মকর্তার আদর্শগত বিতর্ক থাকলেও তারাও নানাভাবে তদবির করে চাকরিজীবনের এই কাঙ্ক্ষিত পদ চাইছেন। নিজেদের সরকারের আদর্শের বলেও নানা জায়গায় পরিচয় দিচ্ছেন তারা। ২০, ২১, ২২ ব্যাচ ছাড়াও পুলিশ ক্যাডারের ১৫, ১৭ ও ১৮ ব্যাচের অন্তত ২৫ কর্মকর্তা এখনো অতিরিক্ত ডিআইজি পদে রয়েছেন। বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে এই কর্মকর্তারাও বিবেচনায় আনার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি চাকরিতে সাধারণত তিনবার কোনো কর্মকর্তা পদোন্নতির জন্য বিবেচিত না হলে পরে আর তাকে পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয় না। এটা নিয়ম না হলেও অনেকটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে ১৫ ও ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নাও নেওয়া হতে পারে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই দুইটি ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা এখন অতিরিক্ত আইজিপি পদে রয়েছেন, অনেকে ডিআইজি। তারা নানা কারণেই পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি পদেই রয়েছে।