প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াল

ঢাকায় সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বেশ কিছু পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। সেখানে সাবওয়ের বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। এরপরও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে সাবওয়ের সমীক্ষা করেছে। যদিও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ৬ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা খরচ করে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণ সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা গেছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, সমীক্ষার কাজটি ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা খরচ করেই করা যেত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) এবং এর আগে যেসব পরিকল্পনা হয়েছে কোথাও ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান এবং সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে সাবওয়ের কথা বলা হয়নি। এই অবস্থায় সাবওয়ের সমীক্ষা করে শত শত কোটি টাকা খরচ করা সরকারি অর্থের অপচয় বৈ অন্য কিছু না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে স্পেন ও জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিবিএ ঢাকায় সাবওয়ে সমীক্ষার কাজ দেয়। প্রথমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় ২১৯ কোটি টাকায়। পরে তা সংশোধন করে ৩২২ কোটি টাকা করা হয়। সেতু বিভাগ জানিয়েছে, এখান থেকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ৩১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা অন্যান্য খাতে খরচ করা হয়েছে।
সমীক্ষার প্রস্তাবিত রুটগুলো হলো, প্রথম রুট : গাবতলী-মাল, টঙ্গী-ঝিলমিল, কেরানীগঞ্জ-কাঁচপুর এবং নারায়ণগঞ্জ-উত্তরা ১৩। দ্বিতীয় রুট : আমিনবাজার-গাবতলী-আসাদগেট-নিউ মার্কেট-টিএসসি-ইত্তেফাক মোড়-সায়েদাবাদ। তৃতীয় রুট : গাবতলী-মিরপুর-১, মিরপুর ১০-কাকলী, গুলশান ২- নতুনবাজার-রামপুরা-খিলগাঁও-শাপলা চত্ততর-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কেরানীগঞ্জ। চতুর্থ রুট : রামপুরা-নিকেতন-তেজগাঁও-সোনারগাঁও-পান্থপথ-ধানমন্ডি ২৭, রায়ের বাজার-জিগাতলা-আজিমপুর-লালবাগ-সদরঘাট।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সাবওয়ে নির্মাণ সম্ভব না হলেও সেতু বিভাগ সমীক্ষায় টাকা খরচ করে নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের তুমুল সমালোচনায় পড়েছে। সাবওয়ে সমীক্ষা চূড়ান্ত করার আগের সেমিনারে ঢাকার দুই মেয়র ও বিশেষজ্ঞরা সাবওয়ের কঠোর সমালোচনা করেন। এছাড়া ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ভবিষ্যতে সাবওয়ের প্রয়োজন হলে এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে কাজ হওয়া শ্রেয় বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। কোনো ধরনের সমন্বয় না করে সেতু বিভাগের সাবওয়ের সমীক্ষা করা নিয়ে নানান সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সেতু বিভাগ আরএসটিপিতে সাবওয়ের বিষয়গুলো যুক্ত করার চেষ্টা করছে।
জানতে চাইলে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে এখনো আসেনি যে, লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করে সাবওয়ে নির্মাণ করতে পারবে। সাবওয়ে নির্মাণ খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার, আমরা এমন আর্থ-সামাজিক অবস্থায় পৌঁছাইনি যে, ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানে এত টাকা খরচ করতে পারব। তিনি বলেন, সাবওয়ে নির্মাণ করা, সেটা চালু রাখা অত্যন্ত খরচের ব্যাপার। এছাড়া ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সাবওয়ে করতে হলেও ওপরের সড়কে অনেক জায়গার প্রয়োজন রয়েছে। সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ নেই। সাবওয়ে নির্মাণের সময় মাটির নিচে অক্সিজেনের জন্য ব্যবস্থাপনা করতেও ওপরে প্রচুর জায়গা লাগে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনা করে এই সময়ে মেট্রোরেল বা সাবওয়েমুখী হওয়া চলবে না। এরচেয়ে আমাদের উচিত বাস সিস্টেমটা উন্নত করা এবং সব সড়কে ফুটপাত তৈরি করে দখলমুক্ত রাখা। তাহলে শহরের ছোট ছোট গাড়ির পরিমাণ কমে যাবে।
এসটিপি, আরএসটিপিতে না থাকার পরও ঢাকার যানজট ও গণপরিবহন সমস্যার সমাধানে সাবওয়ের সমীক্ষার কোনো প্রয়োজন ছিল না উল্লেখ করে ড. সালাউদ্দিন আরও বলেন, এখনো ঢাকার বাস্তবতায় সাবওয়ের প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতেও ঢাকার জন্য বিশাল খরচের সাবওয়ে নির্মাণ না করার পরামর্শ রইল সরকারের প্রতি। তিনি বলেন, ঢাকা নিয়ে আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে টাকা খরচ করার অর্থই হয় না। বরং এসব অর্থ ঢাকা বিকেন্দ্রীকরণে খরচ করতে হবে। মেট্রোরেল, সাবওয়ে নিয়ে আর বাড়াবাড়ির চিন্তা না করতে সরকার বিনীত অনুরোধ জানাব। একটা-দুইটা যা করছে, এটা শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার জন্য যত পরিবহন পরিকল্পনা করা হয়েছে, এসটিপি, আরএসটিপি বা অন্যান্য যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে কোথাও সাবওয়ের কথা বলা হয়নি। এরপরও এসব করার মানে হয় না। আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া নির্মাণ কাজের সময় সড়ক দেবে যাওয়া এবং ভবন ধসে পড়ার মতো ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, একান্তই কোনো সংস্থা যদি নতুন কোনো প্রকল্পের চিন্তা করে থাকে তাহলে তারা শুরুতে পরিকল্পনা সমীক্ষা করতে পারত। এটা করতে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি খরচ হতো না। এ ধরনের কাজ করতে দেশের পরিকল্পনাবিদরা যথেষ্ট ছিলেন। এসব না করে শুরুতে প্রকৌশল সমীক্ষায় কেন চলে যায়। এই কাজগুলো না হওয়ায় সরকারি অর্থের অপচয় ঘটছে। সরকারও এখন এই বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে পারছে না বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাহলে এত অর্থ খরচে আমরা কী পেলাম।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, এই ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সমীক্ষার জন্য কারও কারও বিশেষ আগ্রহ। এটা কেন? এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এরআগেও বেশ কিছু সমীক্ষার নামে কোটি টাকার অপচয়ের উদাহরণ রয়েছে। সরকারকে এসব কাজের আগ্রহীদের খুঁজে বের করতে হবে। কেননা, তাদের কারণে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা গচ্চা গেছে। এদের শাস্তি না হওয়ায় অবাস্তব প্রকল্পে অর্থ অপচয় থামছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনছারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় সড়কপথে সমাধান করা দুরূহ। বিকল্প হতে পারে বিকেন্দ্রীকরণ বা মাটির নিচে যাওয়া। এজন্য অনেক বিষয় ভাববার আছে। নিজেদের কারিগরি জ্ঞান ও মেধা খাটিয়ে কাজগুলো করলে অল্পতে করা যায়। কিন্তু, আমাদের সংস্থাগুলো সেটা না করে পরামর্শক নিয়োগ করে। এটা করলে অর্থ এদিক-ওদিক করা যায়, এজন্য সবসময় সংস্থাগুলো পরামর্শক নিয়োগে আগ্রহী থাকে। নিজেরা করলে এটা করা যায় না। পরামর্শক দিয়ে সমীক্ষার কাজ বেশি করছে সেতু বিভাগ। সড়ক ও জনপথ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব কাজ করছে। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের সমীক্ষাগুলো যদি সংস্থার প্রকৌশলীরা না করতে পারেন তাহলে সরকার এত প্রকৌশলী কেন রেখেছে। এই প্রশ্নগুলো তুলতে হবে। সরকারের সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বেশ কিছু সংস্থা তাদের প্রায় সব ধরনের সমীক্ষা নিজেরা করে। নিজেরা নতুন কিছু করলে সেখানে দেশের এত টাকার অপচয় হয় না। প্রকল্প নিলে পরে তারা আবার কনসালটেন্ট রেখে দেবে। নিজেদের কাজ নিজেরা করতে হবে। ভুল হতে পারে, তাতে অসুবিধার কিছু নেই। এভাবেই নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে। তাহলে সরকারের অর্থ অপচয় কমবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) প্রধান প্রকৌশলী এবং ঢাকার সাবওয়ে সমীক্ষা প্রকল্পের পরিচালক কাজী মো. ফেরদাউস দেশ রূপান্তরকে বলেন, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে এই প্রকল্প শুরুর বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। কেননা, আগে তো জীবন বাঁচানো, তারপর অন্যকিছু।
শাস্তি না হওয়ায় সমীক্ষার নামে অপচয় কমছে না : আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বাইরে সেতু বিভাগের সমীক্ষা বাংলাদেশে প্রথম নয়। এর আগেও এমন বেশ কিছু সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু, এসব যারা করেছেন, তাদের শাস্তি না হওয়ায় এটা বাড়ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দ্রুতগতির ট্রেন বা বুলেট ট্রেন নির্মাণের চিন্তায় ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ করে সমীক্ষা করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে এই উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। যেটা ২০২০ সালে শেষ হয়। ওই সমীক্ষায় বলা হয় ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে ৯৬ হাজার কোটি টাকা লাগবে। ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন। ৫৫ মিনিটে যাওয়া যাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। সরকারের ৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় এমন বিষয় না থাকলেও ওই সমীক্ষা করা হয়েছে। আর ২০১৮ সালে ঢাকায় বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা শুরু হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, ৭১ হাজার কোটি টাকা লাগবে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ করতে। এতে ২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা খরচ করা হয়। এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়কের পাশে চারলেনের উড়াল সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ২০১১ সালে। এই সমীক্ষায় সরকার খরচ করেছে ৯৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় এসব বাস্তবায়ন করাও সম্ভব নয়।