ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কমছে

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব খর্ব হচ্ছে। এক পরিবার থেকে তিনজনের বেশি পরিচালক হতে পারবেন না—এমন বিধান রেখে ‘ব্যাংক কম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনের খসড়া অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে শনাক্ত হলে তাঁর ওপর গাড়ি-বাড়ি, জমি রেজিস্ট্রেশন ও বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ ছাড়া যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলো অধিদপ্তর থেকে কম্পানির নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবে না। ঋণখেলাপিদের বিদেশ যেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে সচিবালয়ে আয়েজিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান। জাতীয় সংসদের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দেবেন, তার খসড়াও মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মাহমুদুল হাসান বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক পরিবর্তন করে এখন সর্বোচ্চ তিনজন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক পরিবারের সদস্যদের জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ব্যাংক কম্পানি আইন ১৯৯১-এর ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকে একই পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক আছেন। ব্যাংক কম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩ সংসদে পাস হলে তিনের অধিক পরিচালককে সরে যেতে হবে।
ব্যাংক কম্পানি আইন ১৯৯১-এর সেকশন ১৫ অনুযায়ী একই পরিবার থেকে দুজনের বেশি একই ব্যাংকের পরিচালক হতে পারতেন না। কিন্তু ২০১৮ সালে এই বিধান পরিবর্তন করার পর একই পরিবারের সর্বোচ্চ চারজন সদস্য একই ব্যাংকের পরিচালক হতে পারতেন।
সূত্র জানায়, গত ৩১ বছরে ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছিল সর্বশেষ সংশোধন।
তবে তিনজন পরিচালক রাখলে পারিবারিক বলয়ের প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দীন আহমেদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের সংশোধনীর আগে দুজন ছিল তিন বছরের জন্য। তিনজনের সঙ্গে নিজের মতো করে অন্য পরিচালকসহ পরিবারের মতোই হয়ে যায় পর্ষদ। এটা দুজনই থাকা উচিত সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত। তিনজন পরিচালক রাখার যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি।’
তিনজন পরিচালক থাকলেও ব্যাংকে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতির সুযোগ থাকবে বলে মনে করেন সালেহউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘পর্ষদে মালিকদের চাপে ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে নানা অনিয়মে জর্জরিত দেশের ব্যাংক খাত। তাই পরিবারতন্ত্রের ঝুঁকি থেকে ব্যাংককে বের করে আনতে হবে। ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি জোরদার করতে চূড়ান্ত আইন পাসের আগে এটা দুজন করা উচিত।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক প্রভাব কমানোর জন্য এটা করা হচ্ছে। পরিবারের বাইরে অন্য পরিচালকের সংখ্যা বাড়বে। এখন কয়েকটি ব্যাংকে তিনজনের বেশি পরিচালক আছে।’ সেই সংখ্যা কত তা তিনি জানাতে পারেননি।
কী আছে ব্যাংক কম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩-এর খসড়ায় : এদিকে নতুন এই সংশোধিত আইনের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি আইনে থাকছে। নতুন ব্যাংক কম্পানি আইনের খসড়ায় ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, নামে-বেনামে বা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তাঁকে বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পরও কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করেন তবে ব্যাংকিং আইনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংককে খেলাপিদের তালিকা সম্পর্কে অবহিত করবে বলে জানান মাহমুদুল হোসাইন খান। তিনি বলেন, এরপর তাদের ট্রেড লাইসেন্সের নিষেধাজ্ঞা, বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানির কাছে কম্পানির নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। তবে যদি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে না পাঠায় সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ও সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে। তার পরও নির্দেশনা লঙ্ঘন অব্যাহত রাখলে বা খেলাপিদের তালিকা না পাঠালে প্রতিদিনের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ সাপেক্ষে তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সময় পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়ার যোগ্য হবেন না। এ ছাড়া কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণগ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে। কোনো ব্যাংক বা কম্পানির অর্থায়নে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানে যেন বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত তদন্ত করতে পারে, সেই ধারাও সংযোজন করা হয়েছে ব্যাংক কম্পানি আইনে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার) সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ৩৪টি ধারা রয়েছে।
সূত্র মতে, সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়, কোনো ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হিসেবে অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন না। তবে এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ ছাড়া ব্যাংকের পরিচালক হওয়া ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের অপর ব্যক্তি একই ব্যাংকে পরিচালক হতে পারবেন না। পরিচালনা পর্ষদে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা যাবে না।
ব্যাংক কম্পানি আইনের নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করে যে তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে সেটির কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। আর্থিক অবস্থা খারাপ বলতে তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা সম্ভব না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। দেশের কোনো ব্যাংকের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেলেও সরকার এত দিন সেটিকে সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। সে অবস্থা আর থাকছে না। এবার দুর্বল ব্যাংক সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, অথবা দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন হবে—এমন ধারাই যুক্ত হচ্ছে ব্যাংক কম্পানি নতুন আইনে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, ঋণখেলাপিদের দেশের বাইরে যেতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হলে ৫০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। এই জরিমানা এককালীন দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে।
ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে অনলাইনে : মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। সচিব জানান, বিদ্যমান ভূমি উন্নয়ন করের ক্ষেত্রে বাংলা বছরের ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। কিন্তু খসড়া আইনে করের ক্ষেত্রে অর্থবছরকে (জুলাই-জুন) বিবেচনা করা হবে। এ আইন পাস হলে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে (অনলাইনে) কর দিতে হবে। ভূমির মালিক যদি টানা তিন বছর ভূমি উন্নয়ন কর না দেন তবে বছরে ৬.২৫ শতাংশ হারে জরিমানা আদায় করা হবে। আগের মতো ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফের বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। প্রতিবছর কার কত ভূমি উন্নয়ন কর আরোপ করা হয়েছে তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেবেন। তা নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে সেটিরও সুযোগ রাখা হয়েছে। বিশেষ সময় বা অনিবার্য কারণবশত এই করের হার সরকার হ্রাস করতে পারবে বলে জানান মাহমুদুল হোসাইন খান।