মা-বাবার চেয়ে মাদক বড়

মনির হোসেন, বেনাপোল:
মাদকের সর্বনাশা ছোবলে তরুণ ও যুব সমাজ বিপর্যয়ের মুখে। মাদক সেবনকারীরা সহজেই ভুলে যাচ্ছে কে আপন কে পর। নেশার টাকা না পেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করছে না। মা-বাবার চেয়ে তারা মাদককে বড় মনে করছেন। যশোরে গত কয়েকদিনে মাদকাসক্ত সন্তানের নেশার টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ঝরে গেছে তিনটি প্রাণ। এরমধ্যে সন্তানের মারধরের শিকার হয়ে দুইজন ও ধাওয়া খেয়ে একজন মারা যান। বিগত দিনে একসঙ্গে মা-বাবাকে গলা কেটে হত্যার মত মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ মে দুপুরে যশোর শহরের মণিহার সিনেমা হলের পাশের ফলপট্টির সামস মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে পুলিশ সুলতানা খালেদা সিদ্দিকী রুমির (৬২) মরদেহ উদ্ধার করে। তিনি ওই এলাকার মৃত শাহাজাহান শেখের স্ত্রী। আগের দিন ২৩ মে রাতে মাদকাসক্ত ছেলে সামস তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। রুমির লাশ উদ্ধার সময় পুলিশ সামসকে আটক করে। রোববার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রহমত আলীর আদালতে মাকে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন পালিত ছেলে সামস। তিনি স্বীকারোক্তিতে বলেন তর্কতর্কির একপর্যায়ে মা তাকে একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে মারতে আসেন। ওই লাঠি কেড়ে নিয়ে মায়ের মাথায় আঘাত করলে মারা যান। হত্যার ঘটনায় নিহত রুমির ভাইয়ের ছেলে জুবায়ের তানভীর সিদ্দিকী জয় কোতয়ালি থানায় শেখ সামসকে আসামি করে মামলা করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, নিঃসন্তান খালেদা সিদ্দিকী রুমি ২২ বছর আগে সামসকে দত্তক নেন। সামস নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তারপর লেখাপড়া করেনি। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। টাকা পয়সা নিয়ে তার ফুফুর সাথে বিবাদ করতো । গত ২৩ মে রাতে সামস মাদক সেবনের টাকা দাবি করলে দিতে অস্বীকার করে ফুফু। এই নিয়ে মা-ছেলের মধ্যে বিবাদ হয়। এরই জের ধরে সামস তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
গত ১৯ মে যশোর শহরের বারান্দী মোল্যাপাড়ায় নেশাখোর ছেলের ধাওয়া খেয়ে বৃদ্ধ আব্দুর রহমান ফারাজী (৭৭) মারা যান। তিনি মোল্যাপাড়ার মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে। ঘটনার দিন দুপুরে নেশা করার জন্য বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রহমান ফারাজীর কাছে ১শ’ টাকা দাবি করেন তার ছেলে মুন্না। বাবা টাকা দিতে পারবেন না জানালে তিনি ক্ষুব্ধ হন। মুন্না তার বাবাকে গালিগালাজ করার পর মারতে উদ্যত হলে দৌড় দেন। ছেলের ধাওয়ায় এলাকার জাহাঙ্গীর নামে একজনের বাড়ির সামনে গিয়ে আব্দুর রহমান ফারাজী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ মাদকসেবী মুন্নাকে হেফাজতে নিয়েছিলেন।
এর আগে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বুধোপুর গ্রামের ইখলাস মোল্যাকে (৫০) লাঠিপেটা করেন মাদকাসক্ত ছেলে তারেক। পরে গত ১ জানুয়ারি যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নিহত ইখলাস বাঘারপাড়া উপজেলার বুধোপুর গ্রামের মৃত ইজাজ মোল্যার ছেলে। মাদক সেবনের প্রতিবাদ করায় তারেক ক্ষুব্ধ হয়ে বাঁশ দিয়ে তার বাবা ইখলাসের মাথায় আঘাত করেছিলেন।
এদিকে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর যশোরের চৌগাছা উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে মাদকসেবি সন্তানের হাতে এক দম্পতি খুন হয়েছিলেন। তারা হলেন রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা মহিরউদ্দিন (৬৬) ও তার স্ত্রী আয়না বেগম (৫৪)। নেশার টাকা না পেয়ে মাদকাসক্ত ছেলে মিলন হোসেন মা-বাবাকে গলা কেটে হত্যা করে। এলাকাবাসী মিলনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। মর্মান্তিক ঘটনাটি তখনকার সময় বেশ আলোচিত হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক আসলাম হোসেন জানান, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত মাদকদ্রব্যসহ ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে মাদক নির্মুল করা সম্ভব না। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করার জন্য মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বোঝানোর পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, মাদক মানুষকে হিংস্র করে তুলছে। ফলে সেবনকারীরা আপনজনকে খুন জখমসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা.হুসাইন শাফায়াত জানান, তরুণ ও যুবসমাজ মাদকের আক্রমণে ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়। মাদকে আসক্ত হওয়ার পর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এর পরিণামে সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং রাহাজানি যেন খুব সাধারণ ঘটনা। সমাজে নেমে আসে চরম অবক্ষয়। নিজেদের অজান্তে তারা অনেক বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় তাদের মস্তিষ্ক বিকৃতি আশঙ্কা থাকে। মাদক থেকে মুক্তির জন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, মাদকসেবীদের ঘৃণা না করে মনোচিকিৎসক, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী কিংবা প্রশিক্ষিত কাউন্সিলরের সেশনে বসে অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও মাদককে না বলার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসনাত জানান, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। অপরাধ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবুও মাদকের কারবার বন্ধ হচ্ছে না। মাদক সেবন করে তরুণ ও যুবসমাজ হিংস্র হয়ে উঠছে। নেশায় বুঁদ হয়ে তারা আপনজনকে হত্যা করছে। অভিভাবকদের সব সময় সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। তারা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে,বাসায় দেরি করে ফিরছে কেনো নিয়মিত জবাবদিহিতা প্রয়োজন।