শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৮ অপরাহ্ন

রাস্তা দখলের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে  শ্রমিকদল নেতার মামলা

রিপোর্টারের নাম : / ২৩৬ বার পড়া হয়েছে।
সময় কাল : শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আশরাফুল হক, লালমনিরহাট: ঘটনার প্রায় দুই বছর পর গতকাল শনিবার লালমনিরহাটে রেলশ্রমিক দল কার্যালয় ‘ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের’ অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় আজকের পত্রিকার লালমনিরহাট প্রতিনিধি খোরশেদ আলম সাগরকে আসামী করা হয়েছে। আসামীর তালিকায় জেলার তিন ঠিকাদারের নামও রয়েছে। যাদের মধ্যে দুজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি দরপত্র প্রক্রিয়াধীন থাকা দুটি সড়ক দখলকে কেন্দ্র করে অভিযোগ করায় মামলায় ঠিকাদারদের এবং সংবাদ প্রকাশ করায় ওই সাংবাদিককে হয়রানী করতে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি অতি উৎসাহী পুলিশ কোনো ধরণের তদন্ত ছাড়াই মামলাটি নথিভূক্ত করেছে। মামলার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর জেলায় কর্মরত সাংবাদিক ও ঠিকাদারদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এঘটনায় সাংবাদিকদেও বিভিন্ন সংগঠন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির(এনসিপি) নেতৃবৃন্দ তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন।

ওই সড়ক দুটি নিয়ে গতকাল আজকের পত্রিকায় ‘খোঁড়া সড়কে জনদুর্ভোগ’ এবং গত ২০ আগস্ট ‘লালমনিরহাটে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সড়কের সংস্কারকাজ দখলের অভিযোগ’ এবং “সড়ক সংস্কারকাজ দখল” শিরোনামে আজকের পত্রিকায় অনলাইন ও প্রিন্টে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

পুলিশ জানায়, গতকাল সদর থানায় বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন ফরিদুল ইসলাম ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি রেল শ্রমিকদলের সহসম্পাদক। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০০-১৫০জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলায় গতকাল ভোরের দিকে তিন নম্বর আসামী ঠিকাদার এলাহী বকস ও চার নম্বর আসামী ওই ঠিকাদারের ছেলে শামসুল ইসলামকে কালীগঞ্জের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় সদর থানা পুলিশ। অপর ঠিকাদার ও পাঁচ নম্বর আসামী ঠিকাদার শাহ আযম নয়নের বাড়িতেও শুক্রবার দিবাগত রাতে অভিযান চালালেও তাকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল বিকালে গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে পাঠানো হলে আদালত জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মামলায় সাংবাদিক সাগরকে ছয় নম্বর আসামী করা হয়েছে।

এজাহারে দাবি করা হয়, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর আসামীরা লালমনিরহাট রেলস্টেশন এলাকায় থাকা রেলশ্রমিক দল কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এজাহারে ঠিকাদার এলাহীকে নির্দেশদাতাদের একজন এবং তার ছেলেসহ অপর ঠিকাদার ও সাংবাদিক সাগরের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।

লালমনিরহাট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র মতে, কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নে ৩ কিলোমিটার ৯৩ মিটার এবং চলবলায় ৫ কিলোমিটার ২৫০ মিটার সড়ক উন্নয়ন বা পাকাকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ৩ কোটি ৯১ লাখ ১৬ হাজার ৫১৯ টাকা এবং ৫ কোটি ৮৭ হাজার ৬০৭ টাকা। দরপত্র অনুযায়ী চন্দ্রপুরে মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড এবং চলবলায় বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন লিমিটেড কাজ বাস্তাবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনোনীত হয়। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠান দুটি পারফরমেন্স সিকিউরিটি বা কার্যসম্পাদন জামানত জমা দিয়েছে। এখন চুক্তিপত্র তৈরি সাপেক্ষে বাস্তবায়নকারী দপ্তর কার্যাদেশ দিলে কাজ শুরুর কথা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির।

তবে অভিযোগ রয়েছে, গত মাসে সড়ক দুটি দখলে নিয়ে কাজ শুরু করেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। এ বিষয়ে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। চলবলা ইউনিয়নের দুহুলী-জোরগাছ সড়কের ব্যাপারে অভিযোগে বলা হয়, কাজটি না করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নানা হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় ৭ আগস্ট রাস্তাটি দখল করে মাটি কাটা শুরু করা হয়। এতে দখলদার হিসেবে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সভাপতি আফজাল হোসেন, আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হামিদুল ইসলাম এবং সাহাদাত হোসেন নামের এক ঠিকাদারের নাম উল্লেখ রয়েছে।

অপর দিকে চন্দ্রপুর ইউনিয়নের বুড়িরহাট-চন্দ্রপুর সড়কের কাজের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়, কে বা কার নেতৃত্বে পলাশী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হামিদুল ১৫ আগস্ট থেকে জোর করে সড়কে মাটি কাটা শুরু করেন।
দুই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এলজিইডির কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) চিঠি দেন। চিঠি পেয়ে ইউএনও মোছা. জাকিয়া সুলতানা দুটি রাস্তা পরিদর্শন শেষে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্সের ‘নির্বাহী পরিচালক’ এলাহী বকস। অপরদিকে বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশনের পক্ষে কাজ তদারকির দায়িত্ব পাওয়া স্থানীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বর্ণা ট্রেডার্সের মালিক শাহ আযম নয়ন। তারা দুজনেই লিখিতভাবে পৃথক পৃথক ভাবে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ও সমস্যা নিরসনে আবেদন করেছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার এলাহী বকস ও শাহ আযম নয়ন বিএনপি নেতাদের রাস্তা দখলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোয় এবং আজকের পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করায় তাদের ‘শায়েস্তা’ করাসহ ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে পরিকল্পিতভাবে দলীয় কার্যালয় ভাঙার মিথ্যা অভিযোগে তাদের নামে মামলা করেছে।

সাংবাদিকের নামে এ ধরণের মামলা করায় জেলার সাংবাদিকরা ফুঁসে উঠেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেও নেতারাও এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা দ্রুত এ মামলা প্রত্যাহারসহ রাস্তা দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের (বিএমএসএফ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী আহমেদ আবু জাফর বলেছেন, ‘কোনো ধরনের পুলিশি তদন্ত ছাড়া একজন পেশাদার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। ২০২৩ সালে একটি রাজনৈতিক দলের অফিস ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০২৫ সালে এসে সাংবাদিক ও কিছু ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা চূড়ান্তভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ পুলিশকে পেশাদার ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আহমেদ আবু জাফর আরও বলেন, ‘আপনারা এখনো যা খুশি তা করবেন, এভাবে চলবে না। তিনি অবিলম্বে সাংবাদ খোরশেদ আলমকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান। অন্যথায়, সারা দেশে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন তিনি।

প্রেস ক্লাব লালমনিরহাটের আহবায়ক আনোয়ার হোসেন স্বপন বলেন, সাংবাদিকদের কন্ঠরোধ করার অপচেষ্টার  এ মিথ্যা মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। দ্রুত এ মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় জেলার ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকরা কঠোর কর্মসুচি গ্রহনে বাধ্য হবে।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরন্নবী বলেন, এ মামলায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিকের নাম রয়েছে তা মামলা হওয়ার পরে জানতে পেয়েছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর