লালমনিরহাটের সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামানের মায়ের নামে বিদ্যালয়েও কলঙ্কের দাগ
আশরাফুল হক, লালমনিরহাট: আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বিশেষ ক্ষমতায় দুই মায়ের নামে গড়ে তুলেছেন একটি প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়। সেখানেও নানান দুর্নীতি আর অনিয়মের কলঙ্ক। নিয়ম নীতির বালাইহীন এ প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর নামে টাকাসহ জমি লিখে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে খোদ মন্ত্রীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ ও স্থানীয়রা জানান, আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের দুই মা ছিলেন। একজনের নাম নুরজাহান আহমেদ অপর জন সামছুন্নাহার আহমেদ। দুই মায়ের স্মৃতি সংরক্ষনে নিজ গ্রাম লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের করিমপুরে ২০১৫ সালে শুধু মাত্র বুদ্ধি, শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধিদের জন্য গড়ে তুলেছেন করিমপুর নুরজাহান সামছৃন্নাহার প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়। মায়ের নামে গড়ে তোলা এ বিদ্যালয়েও রয়েছে কলঙ্কের দাগ। বিদ্যালয়েটিতে চাকুরী দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা ও জমি। টাকা কিংবা জমি দিয়েও চাকুরী না পাওয়ার বিস্তার অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। পাঠদানের বালাই না থাকলেও ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে বিশেষ ক্ষমতায় দেশের একমাত্র হিসেবে করিমপুর নুরজাহান সামছুন্নাহার প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত করেন সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়গুলো সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের অধিনে প্রতিবন্ধি উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে পরিচালিত হয়। যা কোন নিবন্ধিত সংস্থার ব্যানারে গড়ে উঠে। এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা কালিন শিক্ষক কর্মচারীদের অর্থে গড়ে তুলেন নুরজাহান সামছুন্নাহার উন্নয়ন সংস্থা। যার সভাপতি করা হয় মন্ত্রীর ছোট ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টুকে। পদাধিকার বলে তিনিই বিদ্যালয়ের সভাপতি হন আর তার স্ত্রী জেসমিন আখতার পলির বয়স যাই হোক বিশেষ ক্ষমতায় করা হয় প্রধান শিক্ষক। এই সংস্থা আর বিদ্যালয় পেয়ে টাকশাল পেয়ে যান মন্ত্রীর ছোট ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টু। এতেই পাল্টে যায় তার জীবন চিত্র। এক সংস্থার ব্যানার দেখিয়ে সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের বড় বড় প্রজেক্ট বাগিয়ে নিয়ে কমিশনে বিক্রি করে হাজার কোটি টাকার মালিক হন ভুট্টু।
প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ের শিক্ষক কর্মচারীরা টাকা ও শারীরিক পরিশ্রম করে বিদ্যালয়টি গড়ে তুললেও এমপিও করাতে চাহিদা মত অর্থ যোগান দিতে না পারায় অনেক শিক্ষক কর্মচারীকে বাদ দেয়া হয় এমপিও সীটে। টাকার জোরে অনেক নতুন নামও অন্তর্ভুক্ত হয় এমপিও সীটে। ফলে কেউ বিদ্যালয়ে যোগদান না করেও তিন মাসের বেতন ভাতা পেয়েছেন। অপর দিকে দীর্ঘ ৮ বছর অর্থ ও পরিশ্রম করেও বিনা নোটিশে চাকুরী হারিয়েছেন কেউ কেউ। এমন একজন সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) মোহাইমুনুল হাসান প্রতিকার চেয়ে গত ৩ নভেম্বর জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ শিক্ষক বলেন, করিমপুর নুরজাহান সামছুন্নাহার প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে চাকুরী দেয়ার নাম করে সভাপতি মন্ত্রীর ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টু ওই শিক্ষকের বাবা আজিজুল ইসলামের কাছ থেকে ৫৪ শতাংশ জমি লিখে নেন। সেই ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর যোগদানপত্র নিয়ে নিয়মিত চাকুরী করে আসছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে এমপিও ভুক্ত হলে তার পদে রঞ্জু মিয়া নামে একজন নতুন শিক্ষকের নাম আসে। এমপিও প্রকাশের পরদিন থেকে এ শিক্ষক বিদ্যালয়ে যাতায়ত শুরু করেন। পরে টাকা ও জমি ফেরত দাবি করলে মোহাইমুনুল হাসানকে মেরে ফেলার হুমকী দেন মন্ত্রীর ভাই ভুট্টু।
শুধু মোহাইমুনুল হাসানই নয়, রবিউল ইসলাম, জপা রানী ও হাসিনা বেগম শিক্ষা সহায়ক পদে প্রতিষ্ঠাকালিন থেকে চাকুরী করলেও এমপিওতে তাদের নাম নেই। অফিস সহকারী পদে শুরু থেকে চাকুরী করা রেখা খাতুনকে পদ পরিবর্তন করে করা হয় শিক্ষা সহায়ক (আয়া) আর অফিস সহকারী পদে নাম আসে সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিটন মিয়ার বোন হালিমা বেগমের। এমএ পাস হরিদাস সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেও এমপিওতে নাম আসে শিক্ষা সহায়ক (আয়া) পদে। সমাজকল্যান মন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জেসমিন আখতার পলি ঢাকা শহরে বসবাস করলেও নিয়মিত বিদ্যালয়ে হাজিরা দেখানো হয়। দেশের পেক্ষাপট বদলে গেলে রংপুরে চলে আসেন চাকুরী বাচাতে। প্রধান শিক্ষকসহ প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে প্রতিবন্ধি ধরন (বুদ্ধি, বাক, দৃষ্টি) বিষয়ক ৬ মাসের বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষন আবশ্যক হলেও এ বিদ্যালয়ের কারও প্রশিক্ষণ সনদ নেই। তবে পেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ায় সবাই ভর্তি হয়েছেন সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এমনটা দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট একটি সুত্র।
বিদ্যালয়ের কোন তথ্যই নেই প্রতিষ্ঠান প্রধান জেসমিন আখতার পলির কাছে। কতজন শিক্ষক কর্মচারী বা শিক্ষার্থীর সংখ্যা?। তার দাবি, সবটাই জানতেন তার স্বামী সভাপতি শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টু। যিনি সাম্প্রতিক সময় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রংপুর কারাগারে রয়েছেন। আগে ঢাকা থেকেছেন এখন চাকুরীর জন্য রংপুর থেকে বিদ্যালয়ে যাতায়ত করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার সময় দুই শত জনের মত শিক্ষার্থী ছিল পরে কমে গেছে। তবে কাগজ কলমে ২২৩ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানে ১৮ জন শিক্ষক কর্মচারী রয়েছেন।
সমাজকল্যান মন্ত্রীর কলঙ্ক এখানেই শেষ নয়। সমন্বিত দৃষ্ট প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল নির্মান করে সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়। ২০১৭ সালে সেই হোস্টেল দুইটিও নির্মাণ করা হয় তার নিজ উপজেলা কালীগঞ্জে। একটি বালক হোস্টেল এবং অপরটি বালিকা হোস্টেল। বালক হোস্টেল করা হয় মন্ত্রীর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত করিমপুর নুরজাহান সামছুন্নাহার প্রতিবন্ধি বিদ্যালয় চত্ত্বরে। আর বালিকা হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয় করিম উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় চত্ত্বরে। যার প্রধান শিক্ষক মন্ত্রীর ভাই খুরশীদুজ্জামান আহমেদ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ করা হলেও তাতে কোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি নেই। বালক হোস্টেল ব্যবহার হচ্ছে মন্ত্রীর মায়ের নামের বিদ্যালয়ের অফিস। বালিকা হোস্টেল ব্যবহার করছেন মন্ত্রীর ভাইয়ের বিদ্যালয়। যার কারনে হোস্টেল নির্মান করা হলেও তার জনবল নিয়োগ দেননি সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ।
বিদ্যালয় ও সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধিদের হোস্টেলের তথ্য জানতে লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিপ্তরের উপ পরিচালক মুহাম্মদ মতিয়ার রহমানের কাছে গেলে তিনিও তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য অফিসে এ সংক্রান্ত কোন ফাইল নেই। তবে শুনেছি, হোস্টেলের ফাইল মন্ত্রীর ছোট ভাই শামছুজ্জামান আহমেদ ভুট্টুর কাছে। যিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। প্রতিবন্ধি বিদ্যালয়টিও কোন নথি নেই অফিসে। মুলত বিগত সময়ে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারাই সব বলতে পারবেন। সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বিদ্যালয় ছাড়া এসব হোস্টেল নির্মাণ অযৌতিক। কোন জনবলও নিয়োগ দেয়া হয়নি।