হুমায়ুন আজাদ হত্যায় ৪ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড
বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার জঙ্গিকে মৃতু্যদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বুধবার ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃতু্যদন্ড পাওয়া চার জঙ্গি হলেন- মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগনে শহীদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে শামীম। চারজনের মধ্যে জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর ও আনোয়ারুল কারাগারে আছেন। সালেহীন ও নূর মোহাম্মদ পলাতক।
১৮ বছর আগের এ ঘটনার মামলায় গত ২৭ মার্চ আদালতে যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত রায় ঘোষণার জন্য ১৩ এপ্রিল দিন ধার্য করেন। সে অনুসারে রায় হলো।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকের ফুটপাতে সন্ত্রাসী হামলায় মারাত্মক আহত হন লেখক হুমায়ুন আজাদ। হামলার পর তিনি ২২ দিন সিএমএইচে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসা নেন। ওই বছরের ১২ আগস্ট তিনি জার্মানির মিউনিখে মারা যান।
ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ছোট ভাই মঞ্জুর কবির বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। পরে তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়া একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও একটি মামলা হয়। ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আবুল আব্বাস ভূঁইয়া ও গোলাম মোস্তফা নামে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম, হাফিজ মাহমুদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু। আসামিদের মধ্যে সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু পলাতক এবং হাফিজ মাহমুদ মারা গেছেন।
২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর এ মামলার বাদী মঞ্জুর কবির মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। ওই বছরের ২০ অক্টোবর বিচারক আবেদন মঞ্জুর করে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ওই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
‘গৎবাঁধা’ রায়’ : হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ফাঁসির রায় হয়েছে? ওই গৎবাঁধা। যাদের ফাঁসি হলো তারা আদৌ ছিল কিনা কে জানে? যে মূল আসামি তাকেইতো মামলায় রাখা হয়নি। প্রতিক্রিয়া দিয়ে কী হবে, ভাইতো ফিরবে না। যিনি নিহত হয়েছেন, তিনি (হুমায়ুন আজাদ) হামলায় আহত হওয়ার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে দায়ী করেছিলেন। তাকেই যখন বাদ দেওয়া হলো, তারপর তো আর কিছু থাকে না।
সেই রাতে যা ঘটেছিল : ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি অমর একুশে বইমেলা শেষ হতে আর মাত্র দুদিন বাকি; অন্য সব দিনের মতো প্রাণের মেলা থেকে ফিরছিলেন বহুমাত্রিক লেখক, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু ঘাতকরা চাইল প্রথাবিরোধী এই লেখককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে; ছুরি-চাপাতি নিয়ে হামলে পড়ল তার ওপর।
চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হলেও সেই আঘাতের পর তার জীবন প্রদীপ জ্বলেছিল মাত্র ছয় মাস।
রাতে বইমেলার নির্ধারিত সময় যখন শেষ হচ্ছে, তখন পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে ফেরার পথে আক্রান্ত হন হুমায়ুন আজাদ। আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের অভিযোগপত্র আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় একটি ধারণা পাওয়া যায়, কী ঘটেছিল সেই রাতে।
সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন, ঘটনার দিন জেএমবি নেতা আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান মিনহাজ একটি চাপাতি নিয়ে, জেএমবির ‘কিলিং স্কোয়াডের সদস্য’ নূর মোহাম্মদ ওরফে শামিম কাঠের বাটওয়ালা সামনের দিকে তিনটি ছিদ্রযুক্ত ছুরি নিয়ে, ভাগ্নে শহিদ ও নুরুলস্নাহ হাফেজ বোমা নিয়ে রাত ৮টার দিকে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে অবস্থান নেয়।
এরপর রাত সোয়া ৯টার দিকে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বই মেলা থেকে বের হয়ে হেঁটে পূর্বপাশের ফুটপাত দিয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় আক্রান্ত হন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছালে আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে ঘেরাও করে ফেলা হয়।
সিআইডির পরিদর্শক বলেন, মিজানুর রহমান মিনহাজ ও শামিম ব্যাগ থেকে চাপাতি ও ছুরি বের করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ঘাড়ে, মাথায়, মুখে, গলায়, হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত ও মারাত্মক জখম করে ঘটনাস্থলে চাপাতি ও ছুরি ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে ভাগ্নে শহিদ ও হাফেজ নুরুলস্নাহ তাদের ব্যাগে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ধকারে জনগণের সাথে মিশে যায়।’
দ্রম্নত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর রাত ১১টার দিকে পৃথক পৃথকভাবে ঘাতকরা মাদারটেকের একটি বাসায় পৌঁছায়। এরপর তারা জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানকে মোবাইল ফোনে ঘটনা জানায় বলে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে লিখেছেন।
ওই ঘটনায় শায়খ রহমান ও সানি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। অন্য মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় তাদের বিচারের সুযোগ হয়নি।
হামলার ঘটনার পর রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল হাসান। এ মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছেন।
সেদিনের কথা স্মরণ করে শরিফুল বলেন, ‘আমি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গান শুনছিলাম হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো। নিজেকে খুব সাহসী বলব না, তবে ভয়টা একটু কম! তো কোথা থেকে এলো সেই শব্দ, সেটি জানতে টিএসসি থেকে দ্রম্নত হাঁটা শুরু করলাম বাংলা একাডেমির দিকে। আজো মনে আছে, রাস্তার মাঝে যে সড়ক বিভাজন ছিল, সেটি ধরে হাঁটছিলাম। এক জায়গায় কয়েকজন লোকের ভিড় দেখে গেলাম। আগেই বলেছি, রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে অছে রক্তাত্ব একজন মানুষ। কিন্তু কেউ ধরছে না।’
হাসান জানান, ‘আগে সামনাসামনি না দেখলেও বইয়ের ফ্ল্যাপে কিংবা পত্রিকায় ছবি দেখে হুমায়ুন আজাদের চেহারা তার বেশ পরিচিতই ছিল। কাছে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন একজন মানুষ। পুরো মুখমন্ডল রক্তাক্ত। আমি ধরে মুখটা ঘোরাতেই চিনতে পারি। এরপর চিৎকার করে বলি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হুমায়ুন আজাদ। এখনি হাসপাতালে নিতে হবে! কিন্তু কীভাবে নেব?”
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের তখনকার সংগঠক, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর সাথে যোগাযোগ করার কথা জানান হাসান।
হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পাশ দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেট কারকে অনুরোধ করলেও চালক রাজি হননি। অগত্যা রক্তাক্ত লেখককে কাছাকাছি থাকা পুলিশ ট্রাকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই ট্রাকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় হুমায়ুন আজাদকে। ট্রাকে তোলার ওই সময়ে রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদের ছবি তোলেন একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক।
হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশের ট্রাকে হুমায়ুন আজাদের সাথে কথোপকথনের কথা তুলে ধরে শরিফুল হাসান বলেন, “স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছি। এত কাছের ঢাকা মেডিকেল মনে হচ্ছে বহুদূর। স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা আমাকে কই নিয়ে যাও?’ আমি বললাম, স্যার, হাসপাতালে। আপনার কিছু হয়নি। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। স্যার বললেন, ‘আমার চশমা কই?’ আমি বললাম, স্যার, আছে। স্যার বললেন, ‘আমাকে তুমি পুলিশের গাড়িতে কেন নিয়েছ?’ আমি বললাম, স্যার, আমরা আপনার ছাত্র। ঠিক আছে স্যার আমরা এখুনি নেমে যাব।’
ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গুরুতর আহত হুমায়ুন আজাদকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
দ্রম্নত সময়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হাসপাতালে নিতে পেরে যে স্বস্তি শরিফুল হাসান সেদিন পেয়েছিলেন, ছয় মাসের মাথায় তা উবে যায় লেখকের মৃতু্যর খবরে।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমরা পরে জেনেছিলাম, স্যারকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার ১০-১২ মিনিটের মাথায় আমরা হাসপাতালে নিতে পেরেছিলাম। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, আরেকটু দেরি হলে রক্তক্ষরণে স্যার মারা যেতে পারতেন! ভেবে খুব ভালো লাগছিল, যে স্যারকে আমরা বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু আসলে কী বাঁচাতে পেরেছিলাম? ছয় মাস পর তো স্যার মারা গেলেন জার্মানিতে!’