রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:০৭ পূর্বাহ্ন

কাজিপুরের জিসিজি বিদ্যালয়ে ঘুষ বাণিজ্য, সহকারী শিক্ষক রোকেয়ার জীবনাবসান হলেও এমপিও হলো না

গোলাম কিবরিয়া খান (কাজিপুর) সিরাজগঞ্জঃ / ৮০ বার পড়া হয়েছে।
সময় কাল : সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে ২৬ বছর ধরে এমপিওভুক্ত করে দেয়ার আশ্বাসে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি কর্তৃক গৃহীত ঘুষের টাকা ফেরতের দাবীতে শিক্ষিকার মরদেহসহ বিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে স্বজন ও স্থানীয়রা। ঘুষ বাণিজ্য এবং ২৬ বছরে চাকরি এমপিওভুক্ত না হওয়ার হতাশা তার মৃত্যুর কারণ বলে জানান বিক্ষোভকারীরা। প্রশাসনের মধ্যস্থতায় তিন দিনের মধ্যে মৃত শিক্ষকের টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকারে উত্তেজিত জনতা ও স্বজনরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের গাড়াবেড় গ্রামে। মৃত ওই শিক্ষিকার নাম রোকেয়া খাতুন। তিনি উপজেলার জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শাখার ইংরেজি বিষয়ের সহকারি শিক্ষিকা ছিলেন।

সরেজমিন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোকেয়া খাতুন বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভুতবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। গাড়াবেড় গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি। ১৯৯৮ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত পাঠদানও করিয়েছেন তিনি। এমপিওভুক্ত ও বেতন করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় শিক্ষিকার কাছে থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নেয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কাজিপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু, কিন্তু ২৬ বছর কাজের অগ্ৰগতি না হওয়ায় হতাশায় ভেঙে পড়েন ঐ শিক্ষিকা। এমতাবস্থায় গত ৩০ জানুয়ারি ওই শিক্ষিকা গাড়াবেড়ের বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন। পরে সোমবার ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। এতে করে স্বজনেরা ও স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষিকার মৃতদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন এবং ঘুষের সেই টাকা ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান।

বিদ্যালয়ের অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। পরে ৩ আগস্ট, ২০০৪ সালে দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই বছরের অক্টোবরের ২৩ তারিখে নিয়োগ পরীক্ষার পর ৬ নভেম্বর বিদ্যালয়টিতে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রোকেয়া খাতুন। এরপর থেকে অদ্যবধি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে নিয়মিত পাঠদান করাতেন তিনি।

রোকেয়া খাতুনের স্বামী আব্দুল করিম বলেন, ‘আমি নিজেও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলাম। তখন বিদ্যালয়ের ঘর করার কথা বলে আমার স্ত্রী ও আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেয় প্রধান শিক্ষক ফরিদুল। এরপর আমি সেখান থেকে সরে আসলেও আমার স্ত্রী ঠিকই থাকে। বেতন করে দেয়ার কথা বলে পরে দফায় দফায় চার লক্ষ টাকার মত নেয় তারা। কিন্তু বেতন করে দেয়নি।’তিনি বলেন, ‘সব শেষ বেতন করে দেয়ার কথা বলে ২০২২ সালে দুই লক্ষ টাকা চায়। সহকারি শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সাথে থেকে দেড় লক্ষ টাকায় মিট হয়। পরে আমি দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে সভাপতি বাবলু চেয়ারম্যানের পায়ে পড়ি স্ত্রীর বেতন করে দেবার জন্য। সেই টাকাও বিফলে যায়। সব মিলিয়ে আমার কাছ থেকে ৭-৮ লক্ষ টাকার মত নিয়েছে। এমপিওভুক্ত না হওয়া এবং টাকার শোকে আমার স্ত্রী স্ট্রোক করে মারাই গেলো। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই, টাকা ফেরত চাই। সাথে এই দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে যে পরিশ্রম করেছে তার ক্ষতিপূরণ চাই।’

রোকেয়ার বড় ভাই খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার বোনের বেতন করে দেয়ার কথা বলে প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও সভাপতি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু পর্যায়ক্রমে সাত আট লক্ষ টাকা নিয়েছে। কিন্তু বেতন করে দেয় নাই। টাকার শোকে আমার বোন স্ট্রোক করে মারা গেছে। আমরা এর ন্যায় বিচার চাই।’

রোকেয়ার ভাগ্নে হাশেম আলী বলেন, ‘এমপিও ভুক্তির আবেদনের কথা বলে খরচা বাবদ আমার কাছ থেকে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা নেয় বিদ্যালয়টির করনিক লোকমান হোসেন। এর বাইরেও সম্মানীর টাকা চান লোকমান হোসেন।’

করনিক লোকমান হোসেন টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ওই টাকা নিয়ে হেড স্যারকে দিয়েছি। হেড স্যারের বাইরে তো আর আমি কিছু করতে পারবো না।’

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘রোকেয়ার টাকা দিয়েই আমরা বিদ্যালয়ের ঘর উঠাই। বেতন করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় টাকাও নিয়েছি। আমরা রোকেয়ার ৪ লক্ষ টাকা ফেরত দেব আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কাজিপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলুও ঘুষের টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বেতন করে দেয়ার কথা বলে আমরা যে টাকা নিয়েছি তার ৪ লক্ষ টাকা রোকেয়ার স্বজনদের কাছে ফেরত দেব। ইউএনও স্যার এসে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।’

কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন, ‘শিক্ষিকার লাশ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থানের খবরে ঘটনাস্থলে যাই। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সভাপতির সাথে কথা বলি। তারাও টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। বলেছেন আগামী তিন দিনের মধ্যে চার লক্ষ টাকা ফেরত দেবে।’
তিনি বলেন, ‘মৃত ওই শিক্ষিকার নিয়োগের কোন কাগজ পত্রই দেখাতে পারেননি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পরবর্তিতে কাগজপত্র দেখে আমরা মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ করবো।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর

এক ক্লিকে বিভাগের খবর